১৯৮১সালে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রার্থমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন রিয়াজ উদ্দীন। তখন বিদ্যালয়ে শিক্ষক সমস্যা প্রকট। তাই প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীন, ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও আমাকে(ছাদিক আহমদ) অর্থাৎ আমরা তিন বন্ধুকে উক্ত বিদ্যালয়ে অবৈতনিক ভাবে শিক্ষকতা করার অনুরোধ জানালে আমরা রাজী হয়ে বিদ্যালয়ে যোগদান করি। এই সময় বিশেষ করে আমার বন্ধু হোসেন আহমদের প্রচেষ্টায় স্কুলে পর পর দুইটি বৃত্তি আসে। এরই ফাকে ফাকে আমরা বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদেরকে প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা সংগ্রহ করে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের জন্য একটি হাতল চেয়ার ও মেয়েদের জন্য একটি পাকা প্রশ্রাবখানা তৈরি করে দিই।
১৯৮৩ সালে আমি বিদেশ চলে যাই এবং ১৯৮৬ সালের ১০ডিসেম্বর আমার আব্বার অসুস্থতার খবর পেয়ে আবার দেশে আসি। তখন হোসেন আহমদ, ফারুক আহমদ ও আমার শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীনের সাথে দেখা করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে বলি যে, বিদেশ থাকতে আমি একদিন স্বপ্নে দেখেছি এলাকায় একটি হাই স্কুল হয়েছে এবং সে স্কুলে আমি শিক্ষকতা করছি। সম্ভবত এ কথা শুনে রিয়াজ উদ্দীন বলেন, “তোমরা যদি আমাকে সাহায্য করো তাহলে এ বছরই আমি ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী চালু করবো। তখন লন্ডন-প্রবাসী আব্দুল খালিক সাহেব ও দেশে এসেছেন। তাই উনার সাথে আলোচনা করে আমাদের সিন্ধান্তের কথা জানাবো বলে স্থির করি। ঐ রাতে ফারুক আহমদ ও হোসেন আহমদ জনাব আব্দুল খালিক সাহেবের সাথে আলাপ করেন এবং পরের দিন আমরা পাচঁজন অর্থাৎ রিয়াজ উদ্দীন, আব্দুল খালিক (লন্ডনী প্রবাসী), ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও আমি মিলে পরামর্শ করে ১৯৮৬ সালের ২১ অথবা ২২ ডিসেম্বর অভিভাবক ও এলাকা বাসীকে নিয়ে একটি সভার আয়োজন করত: সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আইডিএ কক্ষে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী চালু করে শিক্ষাদান কার্যের সূচনা করি। এ সময় হাজী আব্দুল মনাফ ও হাজী নিসার আলীর সভাপতিত্বে বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা গুলিকে সাফল্যমন্ডিত করতে বিশেষ ভুমিকা রাখেন আব্দুল হেকিম, শওকত আলী, মাশুক উদ্দীন ও আবুল কালাম। পরে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আইডিএ কক্ষের পশ্চিম পাশে ৭ম শ্রেণীর জন্য বাঁশবেত দিয়ে টিনসেডের একটি কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় রিয়াজ উদ্দীন চেয়ার টেবিল, ডেক্স-বেঞ্চ ইত্যাদি যাবতীয় জিনিষ পত্র দিয়ে সহযোগিতা করেন। তখন আমাদের সাথে পর্যায় ক্রমে শিক্ষকতায় যোগদান করেন: আছমান উদ্দীন, বদর উদ্দীন আহমদ (টুনু), মাওলানা আব্দুল লতিফ, হেলাল উদ্দীন আহমদ, আব্দুল মুকিত ও রফিক উদ্দীন (আনা মিয়া) প্রমুখ। প্রথম থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তি ও এলাকার ছাত্রছাত্রীদেরকে এম সি একাডেমি থেকে সার্টিফিকেটসহ নিয়ে আসার দায়িত্ব দেয়া হয় ফারুক আহমদকে। পরবর্তী কালে ফারুক আহমদ জনাব আব্দুল মুকিত সাহেবকে প্রাধান শিক্ষক হওয়ার জন্য তিনির বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করে বিদ্যালয়ের দায়িত্বে নিয়ে আসেন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দ্বিতীয় নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে আব্দুল খালিক (লন্ডনী) সাহেব হোসেন আহমদের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু হোসেন আহমদ তাতে অপারাগতা প্রকাশ করায় আমাদের সকলের আলোচনা সাপেক্ষে পরে তারা মিয়ার প্রস্তাবে এবং হোসেন আহমদের সমর্থনে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া)। পরে পরিচালনা কমিটি আব্দুল মুকিত সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে। প্রায় দুই বছর তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রথমে বিদ্যালয়টির নাম ছিল “রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়”। পরে একটি সভায় মুবিন আহমদ জায়গীরদার (রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়) নামটির সাথে আদর্শ শব্দটি যোগ করার প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।
এক সময় আব্দুল খালিক (লন্ডনী) সাহেবের দান করা জমিতে বাঁশবেত দিয়ে স্কুল তৈরীর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে বাঁশবেত সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল হেকিম, শওকত আলী, মাশুক উদ্দীন, আবুল কালাম ও আমাকে। ঘরের টিন দান করেন হোসেন আহমদ, মাখন মিয়া ও তমজ্জুল আলী (তুতা মিয়া)। মিস্তরীর মজুরীর আটশত টাকা পড়ে আমার ভাগে। আব্দুল ওদুদ ও জিয়া উদ্দীন অন্যান্য কাজের দায়িত্বে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। এরপর কোনও এক সভায় খয়ের উদ্দীন আহমদের (চুনু মিয়া) সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সিমেন্ট দানের আশ্বাসের পরিপেক্ষিতে বাঁশবেত দিয়ে স্কুল ঘরটি তৈরীর পরিবর্তে পরিকল্পিত ভাবে পাকা করে তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঘর তৈরীতে বালু দান করেন রিয়াজ উদ্দীন। আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করেন তমজ্জুল আলী (তুতা মিয়া) এবং আরেক খন্ড জমি দান করেন মাওলানা আব্দুল হক। পরবর্তীতে আব্দুল মজিদ লস্কর (ময়না মিয়া) তার নামে একখানা বড় হল (নির্মাণ) করে দেন। পাকাঘর তৈরীর অর্থাৎ স্কুলের প্রথম সাময়িক পরিক্ষার পর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদেরকে বর্তমান বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এলাকাবাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। তবে বিদ্যালয়টির উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), তমজ্জুল আলী (তুতা মিয়া), মাখন মিয়া, আলা উদ্দীন, আব্দুল ওদুদ, আব্দুল খালিক (লন্ডনী), জিয়া উদ্দীন, ইসমাইল আলী, তারা মিয়া, মাওলানা শওকত আলী, হেলাল উদ্দীন আহমদ, আব্দুল আজিজ, রিয়াজ উদ্দীন, হোসেন, প্রমুখ। পরবর্তী কালে হোসেন আহমদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রায় ত্রিশটিরও অধিক ফ্যান স্কুলে লাগানো হয়। বিদ্যালয়ের প্রথম লাইব্রেরীটি স্থাপিত হয় ফারুক আহমদের ব্যক্তিগত সংগৃহিত বইগুলি দিয়ে। শিক্ষকদের মধ্যে ফারুক আহমদ ও হেলাল উদ্দীন আহমদ বর্তমানে লন্ডনে। তারা প্রথম স্কুল পরিচালনা কমিটির মেম্বারও ছিলেন। হোসেন আহমদ ও বদর উদ্দীন আহমদ (টুনু) বর্তমানে ব্যবসা করছেন। আছমান উদ্দীন সৌদি আরবে, রফিক উদ্দীন আহমদ (আনা মিয়া) স্বেচ্ছায় বিদ্যালয় থেকে অব্যহতি নিয়ে দেশেই আছেন। শুধু আমি ও জনাব আব্দুল মুকিত এখনও শিক্ষকতা পেশায় আছি। বিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের হ্রদয়ের টান এখনও আমাদের টিকেয়ে রেখেছে। এই বিদ্যালয়ের সাথে যাদের গভীর সম্পর্ক ও অবদান ছিল তাদের কেউ কেউ আজ হয়তো আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাদের অবদান আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
ছাদিক আহমদ: অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।
রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, স্বারক গ্রন্থ: ২০০৬ থেকে সংগৃহিত।