“বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা”।গ্রন্থালোচনা-আবু মকসুদ।
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৩৬:১৬,অপরাহ্ন ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ | সংবাদটি ১১৪৭ বার পঠিত
বিলাতে বাঙালির পদযাত্রা শুরু হয়েছিলো প্রায় দেড়শত বছর আগে। প্রায় একশ বছর আগে প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। দেড়শত বছরে বাঙালির অগ্রযাত্রা কম নয়, বিলাতের মূল স্রোতে বাঙালি রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ডাক্তার থেকে শুরু করে বিচারক, সৈনিক, নার্স সহ প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে বাঙালি সগর্বে বিচরণ করছে।
বাঙালি আদতে যেখানেই বসতি গেড়েছে সাথে নিয়ে গেছে এক এক টুকরো বাংলাদেশ। সাহিত্য, সংস্কৃতির পাগলামি বাঙালির সর্বজনবিদিত। বাঙালি গানের জন্য পাগল, কবিতার জন্য পাগল, উৎসবের জন্য পাগল। যে দেশেই অবস্থান করুক উৎসবে বাঙালি চিৎকার করতে লজ্জা পায় না, গলা ছেড়ে গান গাইতে লজ্জা পায় না।বিলাতের দেড়শত বছরের ইতিহাসে বাঙালির এমন পাগলামি কম পরিলক্ষিত হয় নি, বরং দিনে দিনে বর্ধিত হয়েছে। আজ থেকে পঞ্চাশ, ষাট বছর আগেও বাঙালি জমজমাট বাউল উৎসব করেছে। দেশ থেকে প্রখ্যাত বাউল শিল্পী এনে সারারাত গান বাজনায় মেতে থেকেছে। ষাট সত্তর বছর আগেও বিলাতে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়েছে, ঘরোয়া ভাবে পালিত হয়েছে এমন নানাবিধ আরো কত উৎসব। আনুষ্ঠানিক উৎসবের সূচনাও দীর্ঘ ঐতিহ্য ধারণ করে, এখন যে নিয়মিত উৎসব-অনুষ্ঠান দেখা যায় তার শিকড় বহু আগেই বপন করা হয়েছিল।
বাঙালি যারা বর্তমানে বিলাতে বসবাস করেন তাদের অনেকেরই জানা নেই পূর্বপুরুষদের ত্যাগ তিতিক্ষার কথা, বর্তমানের মসৃণ রাস্তা নির্মাণের পিছনে কত ঘাম, কত রক্ত ক্ষরিত হয়েছে অনেকেই জানেনা। পূর্বপুরুষদের ঘামের ফসল আজকের এই বিলাত। বর্তমানে বাঙালি যে দাপুটে জীবনযাপন করছে এর পিছনে আছে কঠিন সংগ্রাম, এর পিছনে আছে কঠিন যুদ্ধ। যুদ্ধজয়ের মহৎ কাহিনী হয়তো একদিন লিখিত হবে, পূর্বপুরুষদের শ্রম ঘামের মূল্যায়ন হয়তো একদিন হবে। হয়তো একদিন বাঙালি কৃতজ্ঞ হবে, পূর্ব-পুরুষদের ঋণ শোধ করার চেষ্টা করবে।সে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, বাঙালি তার অতীত খুঁড়ে দেখছে। পূর্বপুরুষদের পদচিহ্ন ধরে এগুনোর চেষ্টা করছে, পায়ের ছাপের পরিমাপে কতটুকু মাটি নিজেদের হয়েছে সেই হিসাব-নিকাশ করছে।
প্রথম যে পুরুষ বিলাতের বুকে পা রেখেছিল সে তাঁর হৃদয়ে বাংলা এবং বাঙালিত্ব বহন করে এনেছিল। সে তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বাংলা এবং বাঙালিত্ব ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল, এখন পর্যন্ত প্রতিটি বাঙালি বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে, বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করে।
বিলাতে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা দীর্ঘদিনের প্রায় একশো বছর পূর্বে বিলেত থেকে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ১৮২৭ সালে ‘শিগুর্ফ-নামা-ই বিলায়েত’ নামে একটা ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমে বাঙালি প্রথম বিলাতে সাহিত্য চর্চা শুরু করে, এটি সম্ভবত কোন বাঙালির লেখা বিলেত বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন মির্জা ইতিশামুদ্দিন। ভারতীয় সম্রাট শাহ আলমের দূত হিসেবে তিনি আসেন, তিন মাস পরে ফিরে গিয়ে এই ভ্রমণ কাহিনী লিখেন।
বিলাতের সাহিত্য পাড়ায় এই ইতিশামুদ্দিন দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু, এরপরে দীন মহম্মদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, নীরদ চৌধুরী সহ অসংখ্য লেখক সাহিত্যিক তাদের যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিলাত তৃতীয় বাংলা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ঢাকা এবং কলকাতার পরে লন্ডন বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য ব্যাপক পরিচিত।সেই ১৮২৭ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের যে ধারাবাহিকতা তার একটা নথি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। নিষ্ঠাবান গবেষক ফারুক আহমদ পুরনো পরচা ঘেটে ঘেটে পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করেছেন বিলাতের বাঙালির গৌরবময় অতীত।
ফারুক আহমদ আমাদের খননকারী শ্রমিক, তিনি হৃদয় খননের সাথে সাথে আর্কাইভে রাখা পুরনো দলিল-দস্তাবেজ খনন করেন। অজন্তা ইলোরায় আমাদের যে ঐতিহ্য সেই ঐতিহ্যে যুক্ত হয় ফারুক আহমেদের ঘাম নিঃসৃত গবেষণা।ইতোপূর্বে তাঁর বিলাতে বাঙালির পদচারণা বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সম্প্রতি বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে “বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা” নামে একটি গ্রন্থ, এমন গ্রন্থের গুরুত্ব অনুধাবন করেই বাংলা একাডেমি প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছে।বিলাতে বাঙালির অতীত যারা জানতে আগ্রহী, বিশেষ করে সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালির যে পাগলামি তার একটা লিখিত বিবরণ এই গ্রন্থে পেয়ে যাবেন। ফারুক আহমেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা তিনি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেন।
আলোচক:আবু মকসুদ।কবি ও লেখক।লন্ডন।