থানায় নির্যাতনে হত্যা, পুলিশ বলছে আত্মহত্যা!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:০৫:৩৭,অপরাহ্ন ২৭ মার্চ ২০২০ | সংবাদটি ৭০৩ বার পঠিত
বরগুনা থেকে সংবাদদাতা:: বরগুনার আমতলী থানায় হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক শানু হাওলাদার নামে এক ব্যক্তির থানা হাজতে রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ থানা পুলিশের দাবি করা তিন লাখ টাকা না দেওয়া নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
তবে পুলিশের দাবি আসামী শানু হাওলাদার আত্মহত্যা করেছেন।
এ ঘটনায় আমতলী থানার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার মো. আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সহস্যজনক এ মৃত্যুতে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।
বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকালে বরগুনার আমতলী থানায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের কলাগাছিয়া গ্রামে ২০১৯ সালে বছর ৩ নভেম্বর ইব্রাহিম নামে একজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যা মামলার এজাহারে নিহত শানু হাওলাদারের সৎ ভাই মিজানুর রহমান হাওলাদারকে আসামি করা হয়।
ওই আসামির ভাই শানু হাওলদারকে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমতলী থানা পুলিশ ধরে নিয়ে আসে।
তারা আরো জানান, শানুর ছেলে মঙ্গলবার থানায় এসে শানু হাওলাদারকে খাবার দিয়ে গেলেও বুধবার পরিবারের লোকজন এসে আসামি শানু হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। উল্টো পরিবারের লোকজনের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করে তাড়িয়ে দেয়। বৃহস্পতিবার সকালে থানা থেকে খবর দেওয়া হয় শানু হাওলাদার ওসি তদন্তের কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
পরিবারের অভিযোগ, শানুকে ধরে নিয়ে আসার পরে আমতলী থানা ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি আসামির পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করলে শানুর ছেলে ১০ হাজার টাকা ওসিকে দেয়।
বাকি টাকা দিতে না পারায় আসামি শানু হাওলাদারকে থানা হাজতে রেখে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে।
নিহত শানু হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন বলেন, বিনা অপরাধে আমার বাবাকে ওসি ধরে এনে তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছে। আমি ওসির ঘুষের টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমার বাবাকে নির্যাতন করেছে। বাবার নির্যাতন সইতে না পেরে মঙ্গলবার দুপুরে আমি ওসিকে ১০ হাজার টাকা দিই। কিন্তু ১০ হাজার টাকায় ওসি তুষ্ট হয়নি। টাকার জন্য নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়ে বারবার আমার কাছে ঘুষের টাকা দাবি করেন।
তিনি আরো বলেন, বুধবার সকালে আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে থানায় আসি। কিন্তু আমাকে দেখা করতে না দিয়ে ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়। সারা দিনে আমাকে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। ওসি বলেন, টাকা নিয়ে আস তারপর দেখা করতে দেব।
নিহত শানু হাওলাদারের শ্যালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, দুলাভাইকে ধরে আনার পর থেকে আমি থানায় প্রাঙ্গণে ছিলাম। পুলিশ তাকে টাকার জন্য বেধড়ক মারধর করেছে। তার ডাক, চিৎকার শুনেছি। বহুবার চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। উল্টো আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে।
নিহত শানু হাওলাদারের স্ত্রী মোসা. ঝরনা বেগম বলেন, ‘পাঁচজন পুলিশ যাইয়া সোমবার রাইতে মোর স্বামীরে বাড়ি গোনে ধইর্যা আনছে। আনার সময় মোর কাছে টাকা চাইছে। মুই টাকা দেতে রাজি অই নাই হেইয়্যার লইগ্যা মোর স্বামীকে পুলিশে পিডাইয়্যা মাইরা হালাইছে। মুই এইয়্যার বিচার চাই’।
থানার ভেতরে ঝরনা বেগম এই বিলাপ করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল।
আমতলী উপজেলা গুলিশালালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাড. আলহাজ মো. নুরুল ইসলাম বলেন, শানু হাওলাদারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্যাতন করেছে। আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের সাজানো।
আমতলী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান বলেন, থানার ওসি মো. আবুল বাশার টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি।
আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে শানুকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করছি।
আমতলী থানার ওসি মো. আবুল বাশার বলেন, আসামি শানু হাওলাদার বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে ওয়াস রুমে যাওয়ার কথা বলে। সে ওয়াশ রুম থেকে ফিরে এসে এক ফাঁকে হাজতখানার ফ্যানের সঙ্গে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।
হাজতখানায় কোনো ফ্যান নেই, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আগের কথা পাল্টে বলেন, ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জনের কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
টাকা না দেওয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন এমন প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে যান।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা শংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, নিহত শানু হাওলাদারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছ। তবে ময়নাতদন্ত ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে না।
এ ঘটনার তদন্তকারী প্রধান বরগুনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, দায়িত্ব অবহেলার দায়ে ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই মো. আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
তবে তিনি বলেন,অপরাধী যে হোক নিরপেক্ষ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।