আন্দোলনেও রক্ষা পেলোনা ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস’!
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৩:২৮,অপরাহ্ন ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৩৭৫ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: গুড়িয়েই দেওয়া হলো সিলেট নগরীর শতবর্ষী স্থাপনা আবুসিনা ছাত্রাবাস। ১৮৫০ সালে প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই ভবনটি ছিলো আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির নান্দনিক স্থাপনা।ঐতিহ্যের ধারক এই হাসপাতাল ভবনকে অক্ষত রেখে উন্নয়নের দাবিতে সচেতন মহল আন্দোলনে নামলেও শেষরক্ষা হলোনা।
২৫০ শয্যার সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য গত জুলাই মাসে এ স্থাপনা ভাঙ্গার কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। বর্তমানে এই স্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে ফেলে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য এখন পাইলিয়ের কাজ শুরু হয়েছে।
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি রক্ষার দাবি জানানো হয়েছিলো। এই দাবিতে ‘সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ’ নামক একটি প্ল্যাটফর্মে আন্দোলনেও নেমেছিলেন তাঁরা। পাশাপাশি নাগরিকদের আরেকটি অংশ ‘সিলেট উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে ওই জায়গায়ই হাসপাতাল নির্মাণ এবং স্মারক হিসেবে আবু সিনা ছাত্রাবাসের একটি অংশ রক্ষার দাবি জানিয়েছিলো।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাংসদ ড. একে আব্দুল মোমেন স্মারক হিসেবে আবু সিনা ছাত্রাবাসের একটি অংশ রক্ষার আশ্বাস দিয়েছিলেন বলেও সেইসময়ে জানিয়েছিলেন সিলেট উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
তবে বাস্তবে রক্ষা করা হয়নি প্রাচীন এই স্থাপনার কোনো অংশ। নগরীর চৌহাট্টা এলাকার আবুসিনা ছাত্রাবাসের পুরো স্থাপনাটিই গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইটসুড়কি সরানোর কাজ করছেন শ্রমিকরা। পাশাপাশি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য পাইলিংয়ের কাজ চলছে।
সিলেট গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্থানে ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ২০২০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কুতুব আল হোসাইন বলেন, হাসপাতাল ভবন নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে পুরনো স্থাপনা ভাঙার কাজ শেষ হয়েছে। ভবনের কোনো অংশ রাখার কোনো নির্দেশনা আমাদের ছিল না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা ছিল পুরো পুরানো ভবন ভাঙার। এখন পাইল কাস্টিংয়ের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের জুলাই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। তবে যেহেতু কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে তাই আরেকটু সময় বেশি লাগবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে। আশা করছি ২০২০ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে যাবে। বাকি কাজ সম্পন্ন করতে সময় বর্ধিত করা হবে।
গত মার্চ থেকে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনা ভেঙে হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু দিকে বিষয়টি সবার নজরে আসে।
‘সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ’ নামের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই স্থানে হাসপাতাল না বানিয়ে ভবনটি রক্ষার জন্য প্রায় ৩ মাস আন্দোলন করে। এই দাবিতে নগরীতে বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচীর আয়োজন করে সংগঠনটি।
অপরদিকে ‘সিলেট উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঐতিহ্যবাহী এই ভবনের একাংশ রেখে হাসপাতাল নির্মাণের দাবিতে নগরীতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেন। করেন।
এ ব্যাপারে সিলেট উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাকির আহমদ বলেন, আমরা চেয়েছিলাম শতবর্ষী এই ভবন রক্ষা করতে। তাই আন্দোলনে নেমেছিলাম। আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন শতবর্ষী ভবন রক্ষায় সম্মতি দিয়ে হাসপাতাল ভিন্ন জায়গায় সরিয়ে নেয়ার কথা বলেন তখনই একটি চক্র ভবনটি ভাঙতে ষড়যন্ত্র শুরু কর।
তিনি বলেন, এই চক্র কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ভবনটি মাত্র কয়েক লক্ষ টাকায় কিনে নেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু আমাদের আন্দোলনে তাদের সেই লুটের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যাচ্ছে দেখে তারা দুইটি মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীকে দুইটি আলাদা প্ল্যাটফর্মে ভবনটি দ্রুত ভেঙে দেয়ার দাবি জানাতে আন্দোলনে নামায়। ভবনের একাংশ রক্ষার যারা দাবি জানিয়েছিল তারা মূলত পূর্ণাঙ্গভাবে ভবন ভাঙার চক্রের সাথে জড়িত। যারা এই কাজ বাস্তবায়ন করেছেন তারা ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতার মর্যাদা দিতে জানেন না। তারা ইতিহাস, ঐতিহ্যের শত্রু।
এ ব্যাপারে সিলেট উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ পরিষদের আহবায়ক আল আজাদ বলেন, আমরা চেয়েছিলাম ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ভবনটির একাংশ রক্ষা হোক। আমরা আশা করেছিলাম নানা স্মৃতি বিজড়িত এই ভবনের যে মিলনায়তন ছিল অন্তত সেটি রক্ষা করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বাসও দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবে ভবনের একাংশ রক্ষা করা হয়নি। তবে এ ভবনের স্মৃতির কথা ভেবে একাংশ রক্ষা করা উচিত ছিল।
শুরু থেকেই আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন রক্ষার দাবি জানিয়ে আসা বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেট নগরে প্রাচীন স্থাপত্যের অভাব। হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা এই নগরে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা বিভিন্ন কারণে হারিয়ে গেছে। এ অবস্থায় নগরের প্রাণকেন্দ্রে থাকা আসাম প্যাটার্নের এই দৃষ্টিনন্দন ভবন সংরক্ষণ করা সকলের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক এই ভবনটি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই ভবন ভাঙার জন্য একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দায়ী। আগামী প্রজন্মের কাছে এরা ঐতিহ্য ধ্বংসকারী হিসাবে নিন্দিত হবে। ইতিহাস এদের ক্ষমা করবে না।
উল্লেখ্য, ১৮৫০ সালে সিলেট নগরের কেন্দ্রস্থলে ইউরোপিয়ান মিশনারিরা এই ভবনের প্রথম-পর্বের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই ভবন আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির নান্দনিক স্থাপনা। এর সাথে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মৃতিজড়িত। পুরাতন মেডিকেল ভবন বা ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন’ নামে পরিচিত এই ভবনটি এ অঞ্চলের শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক। সিলেট ভূকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে হাজার বছরের পুরনো বিভিন্ন শাসনামলের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়। টিকে থাকা হাতেগোনা কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও বিনষ্ট হতে চলেছে। তাই এই শতবর্ষী আবু সিনা ছাত্রাবাস রক্ষার দাবি জানানো হয়।