ফারুক আহমদ সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক জনমত: মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল’- আ.ফ.ম সাঈদ।
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৪:২২,অপরাহ্ন ০৯ অক্টোবর ২০১৮ | সংবাদটি ৩৮৯০ বার পঠিত
ফারুক আহমদ সম্পাদিত “সাপ্তাহিক জনমত::মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল” – আ.ফ.ম সাঈদ
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির অহংকার। কারন যুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ১৯৭১ সালের২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর তথা ২৬মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালি যে যেভাবে পারেন,অংশ নিয়েছেন।এই অংশ গ্রহণ শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা নয়।মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করা,মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনও রয়েছে।শুধু এদেশে বসবাসকারী বাঙালিই নয়;বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিরাও মুক্তিযুূদ্ধে বিভিন্নভাবে অবদান রাখেন।মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে যুক্তরাজ্যই ছিলো সর্বাধিক বাঙালির বসবাস। জীবন জীবিকার সন্ধানে বা পড়ালেখা করতে যুক্তরাজ্যে বাঙালিরা পাড়ি জমান।সে দেশে বসবাসরত বাঙালিরাও মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন।লন্ডন থেকে প্রকাশিত “জনমত”পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জমনত গঠন সহ প্রবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছু দিন পূর্বে পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়েছিলো।মুক্তিযুদ্ধকালে সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা যেনো ছিলো কামানের গোলা।মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন খবরাখবর ও প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে জনমতে ছাপা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে পত্রিকাটির এই ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে একটি অতি মূল্যবান বই হলো”সাপ্তাহিক জনমত:মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল”।বইয়ের সম্পাদক ফারুক আহমদও যুক্তরাজ্যবাসী।একজন অনুসন্ধানী, ধীমান গবেষক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে।
২৭৬ পৃষ্টার বইয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাত প্রবাসী বাঙালিদের অবদান ছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুূদ্ধের বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনার বিবরণ। বইটির মুখবন্ধে লেখক বলেছেন-“১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী সাপ্তাহিক জনমতের জন্ম হয়েছিলো মহান ভাষা আন্দোলের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে,বিলাতে মাতৃভাষা বাংলায় কৃষ্টি,সংস্কৃতি ও সাহিত চর্চার বাহন হিসেবে।এই কাগজটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইঙ্গিতেই সর্বপ্রথম স্বায়ত্তশাসনের মূলমন্ত্র ৬দফাকে ১ দফায়,অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবি হিসেবে উত্থাপন করেছিলো”।মুখবন্ধে উল্লিখিত বক্তব্যেই মুক্তিযুদ্ধে সাপ্তাহিক জনমতের ভূমিকা পরিস্ফুটিত হয়েছে।
“সাপ্তাহিক জনমত:মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল” বইয়ে সাতটি অধ্যায় রয়েছে। এরমধ্যে সবচে বড় ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো-মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতি সপ্তাহের উল্লেখযোগ্য খবরাখবর।বইয়ের ৭৭নম্বর পৃষ্টা থেকে ২৩৪ নম্বর পৃষ্টা জুড়ে একাত্তরের ৭মার্চ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিরল ঘটনা ও বিষয়ের খবরাখবর রয়েছে।এই দশ মাসে সাপ্তাহিক জনমতের ৪৩ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সমুদয় ঘটনার ইতিহাসই এ সংখ্যাগুলোতে রয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত আদায়ে প্রবাসী বাঙালিদের নানামুখী তৎপরতা ও অবদানের বিবরণও এতে পাওয়া যায়।
আলোচ্য বই থেকে জানা যায়,একাত্তরের২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর লন্ডনে সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো।১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিলের জনমতে”জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী”শিরোনামের খবরে বলা হয়-“বাংলার গণনেতার পক্ষ থেকে আজ শুক্রবার রাতে বাংলার গোপন রেডিএ-“পূর্ব পাকিস্তান কে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়।জননেতা শেখ মুজিব নিজেই এ ঘোষণা প্রচার করেন।নি:সন্দেহে শেখ মুজিবের এক সহকারী বাংলার গণনেতার পক্ষ থেকে দেশবাসী কে উদ্দেশ্য করে বলেন: আপনারা দেশের মুক্তির জন্য এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান। আপনাদের এই সম্মিলিত সংগ্রাম কিছুতেই ব্যর্থ হতে পারে না।জয় আপনাদের অবশ্যম্ভাবী”।সাপ্তাহিক জনমতের এই খবরে শুক্রবার রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বলে উল্লেখ করা হয়।একাত্তরের ২৬মার্চ ছিলো শুক্রবার। যে গোপন রেডিওর কথা বলা হয় তা প্রকৃতপক্ষে ছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের খবরও ছাপা হয় জনমতের ১৮ এপ্রিলের সংখ্যায়।একই তারিখের সংখ্যায় একটি খবরে বলা হয়,বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত আক্রমণের প্রতিবাদে ৩ এপ্রিল লন্ডনে প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি নারী জনসভা করেন।তারা জনসভা শেষে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ডাউনিং ষ্ট্রিটে গিয়ে আবেদনপত্র পেশ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে সাপ্তাহিক জনমতে প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম উল্লেখ করছি।”মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব সাহসিকতা, প্রবাসী বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ:স্টিয়ারিং কমিটির কাজ শুরু,বাংলাদেশের মুক্তিসেনাগণ কর্তৃক সিলেট দখল,তিরিশ লাখ বাস্তুহারা ভারতে,মুক্তিবাহিনী বহু এলাকা মুক্ত করেছেন,স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের মিছিল,লঙ্গিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার,পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লিডসে গণবিক্ষোভ,যশোর-কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের হাতে৭৬ জন পাকসৈন্য নিহত,স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকিট চালু হয়েছে,জয় বাংলা জয় মুক্তিবাহিনী :শেখ মুজিবের মুক্তি চাই,বৃটিশ পার্লামেন্টে ইয়াহিয়ার বিচার দাবি,পাকিস্তান নামের দেশটি আজ মৃত,মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ মুক্ত হবে,বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে লন্ডনে বিরাট জনসভা, পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় ইত্যাদি।
বইয়ে সাপ্তাহিক জনমত প্রকাশনার ইতিবৃত্ত এবং প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্টদের পরিচিতি দেয়া হয়েছে। লেখক ফারুক আহমদ একজন গবেষণাধর্মী লেখক। ইতপূর্বেও তাঁর গবেষণামূলক একাধিক গ্রন্থ বেরিয়েছে। এই বইয়েও তাঁর নির্মোহ গবেষণার ছাপ রয়েছে।বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার বাংলাবাজারের ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। ২০১৬ সালের অক্টোবরে লন্ডনে বাংলাদেশ বইমেলা উপলক্ষ্যে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণে ও ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে “সাপ্তাহিক জনমত:মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল”বইটি প্রকৃতপক্ষেই একটি অমূল্য ও অসাধারণ দলিল।