আনোয়ার শাহজাহান এক কর্মকুশল সৃজনশীল মানুষের প্রতিচ্ছবি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:২৬:৩৫,অপরাহ্ন ০৪ জুলাই ২০২১ | সংবাদটি ১৮৯৯ বার পঠিত
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল ::
আনোয়ার শাহজাহান তারুণ্যে উদ্দীপ্ত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সফল মানুষ। তিনি একাদিক্রমে শেকড়সন্ধানী লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, সংগঠক ও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হলেও একজন লেখক ও গবেষক পরিচয়ে তিনি উদ্ভাসিত। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা ও শেকড়সন্ধানী গবেষণা তার মৌলিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। ছড়া, কবিতা ও প্রবন্ধে তিনি সমান সিদ্ধহস্ত। সাংবাদিকতা জগতে বিচরণরত এই সাহিত্যবান্ধব তার পূর্বসূরিদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। পত্রিকা সম্পাদনায় প্রিন্ট ও অনলাইন দু-মাধ্যমেই তিনি সরব আছেন। সংগঠক হিসেবে তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। তার এলাকার শিক্ষাবিস্তারেও তিনি ভূমিকা রেখে চলেছেন। অর্থাৎ আনোয়ার শাহজাহান যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে।
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় মানুষ। ব্যক্তির বিচারে তার আদর্শের বহুগামিতা থাকতে পারে। কিংবা কেউ কোনো আদর্শের বাইরেও জীবনকে যাপিত করতে পারেন। এটা ব্যক্তির স্বতন্ত্র ইচ্ছে। তবে মানব কল্যাণার্থে নিবেদিত ব্যক্তিরাই আদর্শ মানুষ। তাদের মধ্যে যতটা না আত্মকেন্দ্রিকতা বিদ্যমান, তার চেয়েও বেশি তারা লালন করেন সমাজের চেতনা। ন্যায়-নীতি, মনুষ্যত্বের ধারণে তারা হয়ে ওঠেন সমাজের আদর্শ মানুষ। মূলত, মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব-কর্তব্য, এটাকে উপলব্ধি এবং ব্যক্তির সামর্থ্যভেদে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানসিকতার নামই মহানুভবতা। আনোয়ার শাহজাহানকে আমি সেই রকম মহানুভব ব্যক্তি হিসেবেই দেখি। তিনি কল্যাণকামী সমাজে প্রেরণার ব্যক্তিত্ব।
আনোয়ার শাহজাহানের সঙ্গে আমার পরিচয় গত দুই দশক থেকে। তারপর থেকে আমি তাকে যতই দেখছি, মুগ্ধ এবং বিমোহিত হচ্ছি। বিশেষ করে, যেকোনো কাজে তাঁর একাগ্রতা-নিষ্ঠতা আমাকে বেশ আন্দোলিত করেছে। তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- পরিশ্রমপ্রিয়তা। যেকোনো কাজে তিনি এত বেশি পরিশ্রম করেন যে, তার সুষ্ঠু ফলাফল না আসা পর্যন্ত ক্ষান্ত হন না। এটা আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করে। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং কাজের প্রতি কমিটমেন্ট আমাকে তার আত্মার আত্মীয় হতে প্রণোদনা দিয়েছে। তাঁর সাথে গভীর সম্পর্কের সূত্রে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছি। এতে আমার মধ্যেও তাঁর বহুমুখী চিন্তার সৃজনশীলতার অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হয়েছে। এটি এমন একটি অব্যাহত ধারা যা জীবনকে ভাষা দেয়, সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন থাকতে জৈবনিক প্রেরণা জোগায়। কখনো বা মানসিক শক্তি হয়ে ওঠে। তাঁর সৃজনশীলতা এবং কর্মমুখীতার প্রসারিত ধারার প্রভাবে আমার সঙ্গে তার কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ সময়ও তাঁকে দেখেছি পুঙ্খানুপঙ্খতার নিরিখে।
আনোয়ার শাহজাহান যেমন সৃষ্টিতে নিমগ্ন তেমনই তাঁর সজ্জন এবং কাছের মানুষদেরকে মূল্যায়ন করতে ভুলেন না। এটা তাঁর ব্যক্তিবোধের কৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। যা আমি উপলব্ধি করেছি লন্ডন বইমেলাকে কেন্দ্র তাঁর কর্মকাণ্ডকে পরখ করে। ২০১৮ ও ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত বইমেলায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের স্টলে তিনি ছিলেন এক প্রাণচঞ্চল ব্যক্তিত্ব। বিশেষত, আমার কর্মসূত্রে দেশে অবস্থানকল্পে লন্ডন ভ্রমণ ছিল আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আনোয়ার শাহজাহানের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা আমাকে সেই চিন্তা থেকে অব্যাহতি দেয়। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন-এর স্টলে মূলত তিনিই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। লন্ডনে তাঁর কর্মজীবনের যাপিত সৃজনশীলতায় যে বলয় তৈরি হয়, পাণ্ডুলিপি প্রকাশন স্টলে তিনি ছিলেন তাদের মধ্যমণি। তাঁর আন্তরিকতা ও সহযোগিতায় লন্ডন বইমেলায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের যে রূপ ও বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে, তা মাটিতে পড়েনি। বরং এর সুবাসকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন আনোয়ার শাহজাহান। এজন্য তার প্রতি আমার আন্তরিক টান অনিঃশেষ। বিশেষত তিনি আমার কাছে এক ভিন্ন মানুষ। কল্যাণচিন্তায় তিনি বারবার বিমূর্ত হয়ে অবতরণ করেন সৃষ্টিজগতে কখনো বা তার পছন্দনীয় ক্ষেত্রে। রাখেন প্রোজ্জ্বলতার স্মারক। এছাড়া লন্ডন বইমেলায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক ও গবেষক ফারুক আহমদ, সাংবাদিক ও কবি আহমদ হোসেন হেলাল, কবি ও ঔপন্যাসিক গুলশান আরা রুবী এবং লেখক শফিক আলী প্রমুখ আমাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত করেন।
প্রবাস কিংবা দেশ, দু জায়গায়ই তিনি কর্মমুখী। প্রবাসে যেমন তিনি জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে দৌড়-ঝাঁপ করেন, দেশে আসলে ঠিক শেকড়ের টানে তিনি স্থির থাকেন না। তাঁর চিন্তার প্রসারিত ধারা এবং দেশমাতৃকার প্রেমে তিনি ঘুরে বেড়ান এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম। এটি কোনো অভিন্ন কথা নয়, আনোয়ার শাহজাহানের কর্মপ্রেরণা সেই চেতনাকেই প্রকাশ করে। ব্যক্তির জীবনোদ্দশ্য নিয়ে তিনি ছুটে চলছেন নিরন্তর। সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে আনোয়ার শাহজাহান এক কর্মপ্রেরণার নাম। তাঁর এবং আমার বাড়ি একই এলাকায় হওয়ার সুবাদে পারিবারিক সূত্রেই আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা বেশ মধুর। এই সম্পর্কের রসায়নে আমার কাছে পরিলক্ষিত হয় আনোয়ার শাহজাহানের জীবনদর্শন। বিশেষত, সমাজ ও দেশের জন্য তার অন্তরটা দিলদরিয়া। এর স্পষ্ট নিদর্শন-তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে- এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে তিনি যে কাজ করেছেন তা অনন্য। এছাড়া সিলেটের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ নামক গ্রন্থগুলো উজ্জ্বল স্মারক। এই গ্রন্থগুলোই প্রমাণ করে তিনি দেশের জন্য কতটা নিবেদিত। এই তিনটি গ্রন্থের শেষোক্ত গ্রন্থ দুটি আমার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ দুটির কাজ করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে। বিশেষ করে, এসকল গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে তার ক্ষুরধার চিন্তা আমাকেও দারুণ বিমোহিত করে। কখনো অনুপ্রেরণা জোগায় অন্তরে।
প্রবাস থেকে দেশে ফিরলেই তার সঙ্গে আমার কথা হয়। দেখা হয়। এমনকি প্রবাস জীবনেও আমার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগে কোনো ফারাক পড়ে না। দেশে আসলেই বিভিন্ন সময় সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন। এতে আমি আনন্দিত হই। কারণ, তাঁর মধ্যে আমি শিক্ষার প্রতি একটি নিবেদিতপ্রাণ অন্তর দেখতে পেয়েছি। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আনোয়ার শাহজাহান প্রাথমিক বিদ্যালয়। তিনি শুধু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং প্রতি বছর উক্ত প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিরও ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজসেবায় নিয়োজিত রাখছেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আনোয়ার শাহজাহান সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের রায়গড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী আব্দুল মুতলিব এবং মাতা আনজুমান আরা বেগম। আনোয়ার শাহজাহান ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় তিনি জাতীয় দৈনিক খবর পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক জনতার মিছিল। গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় তার ভ‚মিকাও ছিল অগ্রগণ্য। যুক্তরাজ্যে প্রথমে তিনি পাক্ষিক প্রবাস পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তার সম্পাদনায় লন্ডন বিচিত্রা নামে একটি মাসিক প্রকাশিত হয়। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের প্রথম অনলাইন বাংলা সংবাদপত্র বাংলালিংক ডটকম প্রকাশ করেন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত অনলাইন আমাদের প্রতিদিন-এর সম্পাদকের পাশাপাশি ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ঢাকায় প্রকাশিত ইউনাইটেড নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাজ্য থেকে আমাদের প্রতিদিন অনলাইন পত্রিকা এবং ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন আমাদের গোলাপগঞ্জ। পরবর্তীতে এর অনেকগুলো সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ব্রিটেনের প্রথম অনলাইন সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইউকে বাংলা অনলাইন প্রেসক্লাব’ এর প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক এবং বর্তমানে সদস্য সচিব এর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুক্তরাজ্যস্থ গোলাপগঞ্জ হ্যালপিং হ্যান্ডস-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সহ-সভাপতি এবং বর্তমানে উপদেষ্টা, গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আনোয়ার শাহজাহান ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় লেখক পরিষদ ঢাকা থেকে ‘লেখক সম্মাননা পদক’ এবং ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাজ্যের এসই ফাউন্ডেশন থেকে সাংবাদিকতায় ‘কমিউনিটি জিনিয়াস’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ মধ্যাহ্নের কোলাহল (কাব্য সম্পাদিত ১৯৯৩), ক’জন কৃতীসন্তান (ইতিহাস ও জীবনী ১৯৯৪), সময়ের শ্রেষ্ঠ ছড়া (সম্পাদিত ১৯৯৫), বিলাতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৯৬), গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য (১৯৯৬), স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা (প্রথম খণ্ড-২০১৬) ও দ্বিতীয় খণ্ড-২০১৭, সিলেটের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা (অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮), সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ (ডিসেম্বর ২০১৮), Gallantry award recipient freedom fighters of Sylhet (অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১) উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ (মে ২০২১) নামক একটি গ্রন্থ একই প্রকাশনা থেকে সদ্য প্রকাশিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক। তার পুত্রদ্বয় তানভীর শাহজাহান ও সাব্বির শাহজাহান এবং কন্যাদ্বয় আফসানা শাহজাহান ও তায়্যিবা শাহজাহান। তার সহধর্মিণী নাসরিন শাহজাহান যুক্তরাজ্যের কমিউনিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সাত ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে আনোয়ার শাহজাহান পঞ্চম। তার বড়ো ভাই আনোয়ার আলমগীর ও আনোয়ার জাহাঙ্গীর ইতোমধ্যে একজন সমাজসেবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার ছোটো ভাই ব্রিটেন প্রবাসী আনোয়ার মুরাদ মানবাধিকার ও সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত। তার ছোটো ভাই আনোয়ার মাছুম ও আনোয়ার হুমায়ুন ব্যবসায়ী হিসেবে সফলতার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। ছোটো ভাই আনোয়ার রেদওয়ান ব্রিটেনে আইন পেশায় জড়িত।
আনোয়ার শাহজাহান কৈশোর থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সব্যসাচীর মতোই তার সাহিত্য যাত্রা। তিনি কবি, ছড়াকার, ঐতিহাসিক, সাংবাদিক এবং কলাম লেখক হিসেবে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন। আশির দশকের শেষের দিকে কবিতায় তার উজ্জ্বল পদযাত্রা। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক শুভেচ্ছায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশ পায়। আনোয়ার শাহজাহান একজন সমাজ ভাবনার কবি। তার কবিতায় মানুষের বাস্তব জীবনের চিত্রই প্রতিফলিত হয়। যেমন :
বর্বরতা গোপন প্রণয় সারে হিংসার বাড়িতে
তৃষ্ণার্ত পৃথিবীর কঠিন মৃত্তিকায় লেগে আছে
মুক্তিকামী মানুষের রক্তের দাগ
এ দাগ কি মুছবে না কোনদিন।
অনিন্দ্য পৃথিবী চাই/মধ্যাহ্নের কোলাহল
আনোয়ার শাহজাহান ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ‘সময়ের শ্রেষ্ঠ ছড়া’য় সম্পাদকের কথায় লিখেছেন: ‘সমসাময়িক ছড়ায় শুধু শিশু মনোরঞ্জনই লক্ষ্য নয়। আর্থসামাজিক বাস্তবতার নিরিখে তরুণ যুবসমাজের চিন্তা-চেতনা, ভাব ভাবনা প্রতিফলিত হচ্ছে ছড়ায়। অতীতে ছড়ায় নিটোল শরীর নির্মাণই ছিল প্রধান বিষয়। কিন্তু আজকের রাগী প্রজন্ম নির্মম বক্তব্যকেও ছড়ার হালকা আঙ্গিকে সার্থকভাবে তুলে ধরছে।’
ইতিহাস চর্চায় যে জাতি যত সমৃদ্ধ সে জাতি তত মর্যাদাবান। সমাজে ইতিহাসের তথ্য, চরিত্র ইত্যাদি অনুষঙ্গ ছড়িয়ে থাকে। অনুসন্ধানীরা এই তথ্য-উপাত্ত জড়ো করে ইতিহাস রচনা করেন সততা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে। আনোয়ার শাহাজাহানের ‘ক’ জন কৃতি সন্তান’ (১৯৯৪) এবং ‘গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ (১৯৯৬) তার যথাযথ প্রমাণ। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’-এর বর্ধিত সংস্করণ বের হয়েছে।
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বের হয় আনোয়ার শাহজাহানের ‘বিলাতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ নামক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে বিলাতের শুধু বিশেষ স্থানের বর্ণনাই নয় অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি, তাদের জীবনযাপন এবং ইতিহাসের নানা তথ্য সংযুক্ত হয়েছে। আনোয়ার শাহজাহান গ্রন্থটিতে প্রবাসী বাঙালিদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার চিত্র চমৎকারভাবে অঙ্কন করেছেন।
আনোয়ার শাহজাহান শুধু মৌলিক ও সৃজনশীল রচনাকর্মে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রতিভাকে সাহিত্যপত্র ও গ্রন্থ সম্পাদনায় নিয়ে গেছেন। অর্থাৎ সম্পাদনা তার ক্রিয়াকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন ‘অগ্রগামী’। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে বেরোয় মাসিক প্রবাহ ও মাসিক জনতার মিছিল। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘মধ্যাহ্নের কোলাহল’ নামে যে কাব্য সংকলনটি তার সম্পাদনায় বেরোয় সেটি তার সম্পাদনা জীবনের এক মাইলফলক। সিলেটের নবীন-প্রবীণ আটান্ন জন কবির কবিতা নিয়ে সংকলনটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির লেখাগুলোর বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্যই পাঠক হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। এরপর ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তার সম্পাদনায় বেরোয় ‘সময়ের শ্রেষ্ঠ ছড়া’ নামক এক ছড়া গ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থের আলোচনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য:
ইতিহাস হলো কালের সাক্ষী। সত্য এবং গৌরবের ইতিহাস কখনও হারিয়ে যায় না। তা যুগে যুগে মানুষকে আলো ছড়াতে থাকে। যারা ইতিহাস বিমুখ তারা মূলত কিছুই জানেন না। শেকড়কে জানতে হলে আগে নিজের ইতিহাস জানতে হয়। ইতিহাস না-পড়লে একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে অন্ধ-বধির থেকে যায়। অজ্ঞতার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকে না তার ভেতরে। আনোয়ার শাহজাহানের ‘গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থটি গোলাপগঞ্জের মাটি ও মানুষের ইতিহাস। একটি আঞ্চলিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিবরণ যে এতটা সমৃদ্ধ হতে পারে তা অনেকটা কল্পনা করাও যায় না। এই ইতিহাসকে ঋদ্ধ করার প্রয়াস যে এতটা পরিশ্রমসাপেক্ষ তা এ গ্রন্থ না-পড়লে সে সম্পর্কে ধারণা করা সত্যিই কঠিন। গোলাপগঞ্জের ইতিহাসের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। প্রথম থেকে শেষ অধ্যায় পর্যন্ত তার ইতিবৃত্ত লেখক অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন।
আনোয়ার শাহজাহান ইতিহাসবিদ না-হলেও এ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায় রচনা করেছেন তিনি ইতিহাসের যথার্থ নিয়ম মান্য করে। কোথাও তিনি পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেননি। গোলাপগঞ্জের নামকরণের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে, প্রাচীন কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি ইত্যাদি নিরীক্ষণ করছেন, এছাড়াও ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ার বুক অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থও তাকে বেশ সহায়তা করেছে। অস্পষ্ট কোনো বর্ণনা কোথাও নেই। সব জায়গায়ই সাবলীলভাবে সঠিক ইতিহাস তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এর যথার্থতা তার গ্রন্থের গাঁথুনিতে প্রমাণিত। স্থান কাল ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান, আন্দোলন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল কিছুরই ইতিহাস তার লেখায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও বিস্তারিত বিবরণ আছে এই গ্রন্থে। কেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গোলাপগঞ্জ। কেমন ছিল তার যুদ্ধ ও স্বাধীনতার চিত্র। আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণহত্যা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কথা, বর্ণনা ও নামের তালিকা। প্রতিটি এলাকায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ সতেজ উজ্জ্বল হয়ে আছে এ ইতিহাস গ্রন্থে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রতিটি এলাকা তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। গোলাপগঞ্জও এর ব্যতিক্রম নয়। আসাম ব্যবস্থাপনা পরিষদে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা সাইপ্যাম আন্দোলনসহ অনেক কিছুর বর্ণনা স্থান পেয়েছে সুবিন্যস্ত আকারে। এছাড়াও গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে স্থানীয় গুণী ব্যক্তিদের পরিচিতি। ব্যাখ্যা করেছেন তাঁদের আপন কৃতি ও মহতকর্মের স্বাক্ষর। গোলাপগঞ্জের সামাজিক ও জনপ্রতিনিধিদের পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি আঞ্চলিক সাহিত্যচর্চার চালচিত্রও তুলে ধরেছেন। আনোয়ার শাহজাহানকে তার কর্মই মূল্যায়ন করবে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা:
বাঙালির একমাত্র গৌরবের ইতিহাস হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এই যুদ্ধে বাংলাদেশের নারীপুরুষ হিন্দু মুসলমান সকল শ্রেণির মানুষ এক বিরল আন্তরিকতায় অংশগ্রহণ করেছিল। এরকম আর কখনও ঘটেনি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী খেতাবপ্রাপ্ত ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি দেশ স্বাধীনের প্রায় পাঁচ দশকের কাছাকাছি সময়েও আমাদের কোনো লেখকের পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। জাতি হিসেবে এটা অবশ্যই আমাদের দীনতা প্রকাশ করে। এই অপূর্ণতাগুলোই আনোয়ার শাহজাহানকে গ্রন্থটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করে।’ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার বীরযোদ্ধা সাহসী সন্তানদের সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস, পাঁচ দশকের ভেতরে এ সম্পর্কে যা-কিছু রচিত হয়েছে এরমধ্যে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ বিরল প্রায়।
‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে রচিত হয়েছে। আনোয়ার শাহজাহান সত্যিকার অর্থেই মূল ধারার গবেষকদের অন্যতম, যাঁর গবেষণার মৌল এবং শেকড় অনুগামী। প্রধান বিষয় হলো তিনি যখনই লিখতে বসেন তখন গভীর পঠনপাঠন ও পড়াশোনা করে সেটা লিখতে বসেন। এ বিষয়টা তার গ্রন্থটি থেকে আমরা অনায়াসে অনুমান করতে পারি। গবেষক হিসেবে আনোয়ার শাহজাহানের কৃতিত্বটা এখানেই যে তার গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা ধারায় প্রবাহিত হয়।
‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে স্থান করে নিয়েছেন তিনটি শ্রেণির খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। শ্রেণি প্রক্রিয়া হচ্ছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘বীর-উত্তম’ ‘বীরবিক্রম’। এই বিন্যাস অনুসারে প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি ও মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত তথ্যের সার্বিক দুর্লভ ইতিহাস সন্নিবেশিত করেছেন। খেতাবপ্রাপ্ত ২৪০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বৃত্তান্ত তুলে ধরছেন অসাধারণ যোগ্যতার সঙ্গে, যত্ন করে লিখেছেন অকৃপণ ভাবে। তাঁদের জীবনের নানা ঘটনাসহ একেবারে খুঁটিনাটি সাধারণ ব্যাপারও বাদ পড়েনি। অত্যন্ত সুচারুভাবে যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, যুদ্ধের কৌশল ইত্যাদি আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতিপর্ব সংক্ষিপ্ত হলেও তাদের অংসখ্য রোমাঞ্চকর কাহিনি উঠে এসেছে। এগুলো অনেক বেদনাদায়ক গল্প উপন্যাসের কাহিনিকেও পরাজিত করে। আসলে জীবন যেরকম তা সেরকমই বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে তাদেরকে আগ্রহী করে তোলবে। তাঁর গ্রন্থটি পড়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে রচিত সাহিত্য পাঠে উদ্বুদ্ধ হবে। কারণ, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে পরিমাণ গ্রন্থ রচিত হয়েছে আমার মনে তা আর কোনো বিষয়ে রচিত হয়নি। আমাদের যুদ্ধের ইতিহাস অবলম্বনে সৃষ্ট সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
দ্বিতীয় খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে বীরপ্রতীক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান ইতিবৃত্ত। নিষ্ঠাবান গবেষক হিসেবে গবেষণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। প্রবাসে থেকেও দেশের প্রতি তার ভালোবাসা, দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড চিত্রই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অংশ। রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে বিকৃত ইতিহাসে পরিণত করা হচ্ছে আগামী সময় বা প্রজন্ম এসব আবর্জনাকে চিহ্নিত করতে মুশকিলে পড়বে। যেহেতু ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসেও এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা তৈরি হয়নি। একটা সময় ছিল যখন ইতিহাস বলতে রাজা-বাদশার ইতিহাসকেই বুঝাত। সেই যুগ এখন আর নেই। রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে মূল ইতিহাসকে বিকৃত করার সম্ভবনা প্রবল। আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে হবে। বিলাতে বসে আনোয়ার শাহজাহান মুক্তিযুদ্ধের উপর যে কাজ করেছেন এজন্য তাকে অভিনন্দিত না-করলে কৃপণতা হবে।
খানবাহাদুর মৌলভী শরাফত আলী চৌধুরী’র আমার গত জীবন:
আনোয়ার শাহজাহানের সম্পাদনায় প্রায় ৬৭ বছর পর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে খানবাহাদুর শরাফত আলী চৌধুরীর ‘আমার গত জীবন’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ সিলেটের পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে বের হয়। আমার গত জীবন (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। রহস্যনির্ভর বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনি থাকায় সাম্প্রতিককালের গোয়েন্দা ও সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য গ্রন্থটি প্রাসঙ্গিক ও মনোমুগ্ধকর। খানবাহাদুর শরাফত আলী চৌধুরী ছিলেন গোলাপগঞ্জের একজন কর্মকুশল কৃতী সন্তান। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর তিনি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের চাকুরিতে যোগ দেন এবং দক্ষতা ও যোগ্যতার মাধ্যমে অল্পদিনেই ডিটেকটিভ অফিসার পদে পদোন্নতি লাভ করতে সক্ষম হন। চাকুরি জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ডেপুটি সুপারেনটেনডেন্ট অব পুলিশ পদে অধিষ্ঠিত থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর কর্মজীবন রোমাঞ্চে ভরপুর। গোয়েন্দা হিসেবে তিনি অসংখ্য ভয়ংকর রহস্যের উদ্ঘাটন করেছেন। তাঁর ডিটেকটিভ জীবনের মাত্র একটি রহস্যময় ঘটনার বর্ণনামূলক গ্রন্থ আমার গত জীবন (প্রথম খণ্ড)। এখানে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে গোয়েন্দাগিরির নানাদিক তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি তাই শরাফত আলী চৌধুরীর জীবনের একটা পর্বের চিত্রায়িত রূপ।
সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ:
লেখক আনোয়ার শাহজাহান এই গ্রন্থটিকে চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে উপস্থাপন করেছেন। পৃথক চারটি অধ্যায়ে পর্যায়ক্রমে সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার-এ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ নির্মাণকর্ম নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়গুলোতে যেমন মুক্তিযুদ্ধের বড় স্থাপনা স্থান পেয়েছে, তেমনই নতুন অনেক স্থাপত্যও যোগ হয়েছে। একই সাথে লেখক পরিচিত স্থানের পাশাপাশি অনেক অপরিচিত বা অজানা স্থান যেখানে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম লেখকের এই গ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের না দেখা অনেক ইতিহাস জানতে পারবে। এভাবেই আনোয়ার শাহজাহান প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন অমলিন অবদান। আনোয়ার শাহজাহান তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইতিহাসে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে, দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর অপরিসীম প্রেম সেই চেতনাকেই প্রতিফলিত করে যে, তিনি সৃষ্টিশীলতায়ই খোঁজে পান স্বকীয়তা।
করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে:
‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ (মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়া বিশ্বের চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে করোনার ছোবলে মানবজাতির দূর্যোগময় পরিস্থিতি এবং বিশব্যবস্থার যে পরিবর্তন এটাকেই মূর্তমান করে তুলেছেন এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের বিশ্বব্যবস্থার চাকা স্থবির করে দেওয়ার সময়টাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে। এছাড়াও এই গ্রন্থটি অধ্যয়নের মাধ্যমে যেকোনো একটি মানবতাহীন বিশ্বের চিত্রপটকে চোখের সামনে অবলোকন করবে। অন্যদিকে, বিশ্বময় মৃত্যুপুরীতে অবস্থান করেও মানবতার দেয়াল হয়ে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের সাথেও পরিচিত হতে পারবে। সর্বোপরি এই গ্রন্থটি এক আত্মোপলব্ধির সারনির্যাস পাঠকের চোখে ধরিয়ে দেবে।
আমাদের গোলাপগঞ্জ:
গবেষক আনোয়ার শাহজাহানের সম্পাদনার হাতও ছিল বেশ দক্ষ। তার সম্পাদনায় ও তত্ত¡াবধানে প্রকাশিত ‘আমাদের গোলাপগঞ্জ’ সাময়িকীটি ছিল গোলাপগঞ্জের উজ্জ্বলতার অনন্য দলিল। বিশেষ করে, এই সাময়িকীর মাধ্যমে গোলাপগঞ্জের উন্নয়ন কাঠামোকে তুলে ধরাই ছিল মূল লক্ষ্য। আমার সুযোগ হয়েছে এই সাময়িকীতে সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ করার। এই সাময়িকীতে কাজ করতে গিয়ে আঞ্চলিকতা তথা নিজের এলাকার প্রতি তার দায়বদ্ধতা আমি লক্ষ করেছি। যা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। গোলাপগঞ্জের শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্মের প্রচার-প্রসার এবং বিবিধ বিষয়ের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে এই সাময়িকীটি তার অবস্থান থেকে যথাযথভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছে। এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে এই সাময়িকীটি তথা এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। সর্বোপরি আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এই সাময়িকীটি অসামান্য অবদান রেখেছে। যার মূলেই ছিলেন ব্যক্তি আনোয়ার শাহজাহান।
আনোয়ার শাহজাহান তার কাজের মাধ্যমে সমাজে একটি নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি একজন কীর্তিমান মানুষের প্রতিচ্ছবি। তার কর্মের পরিধি ব্যাপক বিস্তৃত। লেখক হিসেবে তিনি মানুষের প্রতি সংবেদনশীল, গবেষক হিসেবে ঐতিহ্যবাদী, সংবাদিক হিসেবে নিষ্ঠাবান, সম্পাদক হিসেবে দায়বদ্ধ, সংগঠক হিসেবে সফল এবং ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কর্মগুণে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও নিজের জন্মস্থান এবং মাতৃভাষার প্রতি তার দরদ অপরিসীম। তাইতো বাংলাদেশকে নিয়ে তার কর্মব্যাপ্ত জীবন। শত ব্যস্ততার মাঝেও দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে তার ভাবনা। আর সাহিত্যের সৃজনশীলতা নিয়ে তার নিরন্তর যাত্রা। এই যাত্রা অব্যাহত থাকুক। আমরা তার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক