সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ পাঠ প্রতিক্রিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৪৭:৩৮,অপরাহ্ন ২০ জুন ২০২১ | সংবাদটি ১০২৩ বার পঠিত
অধ্যাপক ড. মো. নজরুল হক চৌধুরী
লেখক আনোয়ার শাহজাহানের জনপ্রিয় ইতিহাস গবেষণা ও স্থাপত্য নির্দশন এর উপর একটি বই সিলেটে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ। সিলেট বিভাগে ইতিহাসের স্বাক্ষর বয়ে চলা বেশ কিছু স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধের ইতিহাস ব্যাপক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে এখানে তুলে ধরেছেন। সিলেটে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ বইটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে প্রথম সংস্করণ বের হয়। লেখক আনোয়ার শাহজাহান বইটি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনে দেয়া সে সকল শহীদদের প্রতি উৎর্সগ করেছেন।
বইটি থেকে প্রথমেই জানা যায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত প্রথম ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’। শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক এটি নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতীক বলা হয় অপরাজেয় বাংলাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে ভাস্কর্যটির অবস্থান। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী-পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের প্রতীক এই ভাস্কর্য। এর নির্মাতা মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ১৯৭২ সালের প্রথম বিজয় দিবসে সাভারে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা করেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
এভাবে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এমনকি থানা, ইউনিয়ন, পাড়া -মহল্লায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে এবং তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ও স্মারক ভাস্কর্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত এই স্মৃতি সৌধ ও স্মারক ভাস্কর্যগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক বলা চলে। যা যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মরা জেনে আসছে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান।
বইটি থেকে সিলেট বিভাগে নির্মিত বেশ কিছু স্মৃতি সৌধ ও স্মারক ভাস্কর্য সম্বন্ধে বিষদ জানা যাবে। যা আমাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়তা করবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বেদনাবিধুর এক ইতিহাস বয়ে চলে, সিলেটের বালাগঞ্জের আদিত্যপুর গণহত্যার স্মৃতিসৌধটি। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৩ই জুন, ভোররাতে পাকিস্তানী বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে, স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ৬৫ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুরুষকে হত্যা করে। লুটপাট চালায় পুরো গ্রাম জুড়ে। আতঙ্ক আর ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালায় লোকজন। জানা যায়, সেখানে রাতের অন্ধকারে লাশগুলো মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো। অবশেষে এই হত্যাকাণ্ডে নিহত নিরীহ মানুষগুলোর জন্য ১৯৮৪ সালের ৩০ এপ্রিল, উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্দিষ্ট স্থানটিকে সীমানাদেয়াল দিয়ে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
সিলেটের শমসেরনগর বিমানবন্দরটিকে পাকিস্তানীদের থেকে মুক্ত করতে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সৈনিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। তাঁঁর নামে নির্মাণ করা হয়, ‘শহিদ মুক্তিযোদ্ধা রাইফেলস সৈনিক আব্দুল গাফফার স্মারক তোরণ’।
সিলেট বিভাগের মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান স্বরূপ আরেক স্মৃতি ফলক, মহানগরের চৌহাট্টা এলাকায় অবস্থিত সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।
মুক্তিযুদ্ধে প্রধান সেনাপতি প্রথম জেনারেল খেতাবপ্রাপ্ত সেনা প্রধান এম এ জি ওসমানী। তার নামানুসারে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নামকরণ করা হয়েছে, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। এছাড়া বিমানবন্দরটিও তার নামে নামকরণ করা হয়, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর যা এখন ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেট।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সাধারণ ও অতি নিরীহ, বিশেষ করে দরিদ্র ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বাইরের লোকদের নানা প্রলোভন দেখিয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে মাধ্যমে রিলিফের কথা বলে কিছু কিছু মানুষকে একসঙ্গে জড়ো করে নির্বিচারে হত্যা করেছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার কথা বলে জড়ো করেছে এবং তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় খাদিমনগর চা-বাগানের শ্রমিকদের উপরও বর্বর অত্যাচার চালায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসররা। চা-বাগানটির দূরত্ব সিলেট শহর থেকে ছয় মাইল। এই চা-বাগানের শ্রমিকদের কাজ ও মজুরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল নিয়ে যাওয়া হয় চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোর কাছে। ওই দিন তারা একসঙ্গে ২২ জন নিরীহ শ্রমিককে জড়ো করে। প্রথমে তাঁদের পাকিস্তানি সেনাদের গোলাবারুদ বহন করার প্রস্তাব দেয়। তাতে তাঁরা রাজি না হলে তাঁদের একটা বাঁশ-বেতের বেড়া দেওয়া ঘরে আটকে রাখে। সেখানে একটি বদ্ধ ঘরে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে তাঁদের হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুর্গা হাজং, মতিলাল হাজং, দীলিপ হাজং, বনোয়ারী হাজং, হাড়ো ছত্রী, ভানু ছত্রী, তয়লা ছত্রী, সুধীর রবিদাস, সহদেব রবিদাস, তৈলা ছত্রী, খরবর্ণা রুহিদাস, চরুনায়েক, চিলর হাজং, ইন্দ্র নায়েক প্রমুখ। তবে তাঁদের মধ্যে নারায়ণ দাস নামের একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তিনিই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পরে ওই দিনের লোমহর্ষক ঘটনার কথা লোকজনকে জানিয়েছেন। পরবর্তীতে চা শ্রমিকদের স্মৃতিচারণ করে নির্মিত হয় একটি সৌধ।
সিলেট বিভাগে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয় চেতনা ৭১, যা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধারণ করে আসছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য যার নকশা করেছিলেন শিল্পী মোবারক হোসেন নৃপাল। এতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উচ্চে তুলে ধরার ভঙ্গিমায় একজন ছাত্র এবং সংবিধানের প্রতীকী বই হাতে একজন ছাত্রী রয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, খোলা আকাশের নিচে ভাস্কর্যটি নির্ভীক প্রহরীর মতো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আরো জানা যায়, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। পাকিস্তানি বাহিনী এই এলাকা দখলে নেয়ার পর বিয়ানীবাজার ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। দখলদার বাহিনী তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, স্বজনদের ধরে নিয়ে গিয়ে চালায় নির্যাতন। কাঙ্খিত ব্যক্তিকে পেলেই তাঁকে হত্যা করে। বিয়ানীবাজারের সে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয় একটি সৌধ। যা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্বাক্ষর বয়ে চলে।
১৯৭২ সালে ২ জানুয়ারি শাহবাজপুর বধ্যভূমিতে আব্দুন নূরের মৃতদেহটি পাওয়া যায়। আব্দুন নূর ছিলেন, একজন সমাজ সেবক, গ্রামের দুখী মানুষের সেবায় যিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন পুরোটা জীবন। তারই স্মৃতিচারণ হিসেবে মৌলভী বাজারে রয়েছে, আব্দুন নূর স্মৃতি ফলক।
২৫ মার্চ কালরাতে, বিশেষ করে হিন্দু ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানোর জন্য জগন্নাথ হলে পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করলে সেই রাতে অন্যদের সাথে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যও শহিদ হন। শহিদ এই বুদ্ধিজীবীর জন্ম ১৯৪১ সালের ৩১ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার জন্তরী গ্রামে।
অতঃপর ১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ শহিদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পাঠাগারের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহিদ অনুদ্বৈপায়ন পাঠাগার’ নামে। শুধু তা-ই নয়, এই কৃতী বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিকে চিরজাগরূক করে রাখার জন্য স্বাধীনতার পর নবীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে তাঁর গ্রাম জন্তরী পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘অনুদ্বৈপায়ন সড়ক’ নামে।
আনোয়ার শাহজাহান রচিত এ বইটির ৩৮ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখিত জকিগঞ্জে ছাত্রদের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম যে বিশাল মিছিল হয়, যে মিছিলে নেতৃত্ব দানকারীদের অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা মোঃ ফখরুল হক চৌধুরীর নাম বাদ পড়েছে, যা পরবর্তী সংস্করণে আশা করি সংযোজন হবে। উল্লেখ্য যদিও আমি ছোট ও দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম, কয়েকশ মানুষের সাথে আমিও ঐ মিছিলে অংশগ্রহণ করি। রাতেও বিরাট মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, সেটিতেও আমি ছিলাম।
বইটির ৩৯ নং পৃষ্ঠার ২নং প্যারায় পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে শহিদ হওয়া শিশু ফরিদ উদ্দিনের শাহাদাতের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আমি নিজে। এ ঘটনা ১৮ এপ্রিল নয়। তারিখ ছিল ২৮ মার্চ। ২০/২৫ সেকেন্ডের ব্যবধানে আল্লাহ পাক আমাকে বাঁচিয়েছেন। দৌড়ে যাওয়ার সময় ২০/২৫ সেকেন্ড দেরি হলে আমিও গুলবিদ্ধ হতাম। ফরিদ উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমি আড়াল থেকে তার মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরানো অল্পক্ষণ প্রত্যক্ষ করে ভয়ে আবার দৌড় দিয়ে বাসায় পৌঁছি।
সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকের মানুষও দেশপ্রেমের চেতনায় বলীয়ান হয়ে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে মহান আত্মতাগী সেই সব শহিদের স্মরণে ছাতক ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষের পাশেই নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহন করে চলেছে যুগের পর যুগ।
পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা থাকে। কিন্তু তা কতটুকু নির্ভরযোগ্য স্থান থেকে আমরা জানি সেটাই বড় কথা। এই বইটি একটি নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ। যা প্রতিটি স্থানের বিষদ ব্যাখা থেকে সহজেই একজন পাঠক বুঝতে পারবেন। তাই বইটি আজই সংগ্রহ করুন। আপনার বইয়ের সংগ্রহ ও জ্ঞানের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে বইটির বিকল্প নেই।
লেখক : ডিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদ, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট। অধ্যক্ষ (অব.), সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ।