বই আলোচনা: গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থের একটি পাঠকৃতি
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৫৫:৫৮,অপরাহ্ন ২৪ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৭৩৮ বার পঠিত
:: হামিদ মোহাম্মদ ::
বইপাড়ার আনন্দই আলাদা। মনের বন্ধু বই। ইতিহাস জানার জন্য যদি বই নামক অক্ষরের জাদুঘর হয় সখা, তাহলে তো কথা নেই। কোনো বিরোধ নেই,তর্ক নেই,একনাগাড়ে মানবসভ্যতার আদিঅন্ত,বসতি, বেড়ে ওঠা, সমাজপ্রগতির চড়াই উতরাই হদিশ হাতের কাছে। একরমই হাতের কাছে পেলাম গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থখানা। লিখেছেন আনোয়ার শাহজাহান। ৩৮৪ পৃষ্ঠার বই। প্রকাশকাল ২০১৫।
এ বিশাল গ্রন্থখানা লেখার জন্য আনোয়ার শাহজাহান যখন মনস্থির করেন, তখন থেকে আমার মনে হয় অনিদ্রায় কেটেছে কত প্রহর। কত দিন কত দুর্গম পথে, কত অজানা মানুষের কাছে যেতে হয়েছে, যেতে হয়েছে তথ্যের খোঁজে জল স্থল মাড়িয়ে পাহাড় পর্বত, জনপদে। পুরোনো, দলিল দস্তাবেজ তথ্যভা-ারের খনি থেকে আজলা ভরে এনেছেন সোনালি ইতিহাস। সঞ্চিত তথ্যকে ভাষা দিয়েছেন আনোয়ার শাহজাহান। ভাষিক মোড়কে সৃষ্টি হয়েছে গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও এতিহ্য। এ ইতিহাস গ্রন্থখানা পড়ে উন্মুখ পাঠক জ্ঞানচর্চার প্রতি প্রলুদ্ধ হবেন। মন্তব্যও আসতে পারে লেখক নিজেকেও ইতিহাসের অর্ন্তভুক্ত করেছেন। পাঠকের আরো সহজ স্বীকারোক্তি তিনিও ইতিহাসের অংশ।
গ্রন্থখানা পড়ে নামের যথার্থতাও খুঁজে পাবেন পাঠক। গ্রন্থে রয়েছে চর্তুদশ অধ্যায়। প্রতিটি অধ্যায় পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা চিত্র সম্বলিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় সমৃদ্ধ। আগ্রহী পাঠক প্রত্যেক অধ্যায়ে গোলাপগঞ্জের ইতিহাস জানা ও বুঝার জন্য থমকে দাঁড়াবেন না। এক নি:শ্বাসে পড়ে শেষ করতে মনোযোগী হবেন।
সমগ্র গ্রন্থে গোলাপগঞ্জের পরিচিত ও নামকরণ, ভৌগলিক পরিচয়,রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিভাগ,ধর্মভিত্তিক তথ্য সংযোজন,রাজনৈতিক আলোচনা, আন্দোলন সংগ্রাম,মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের মানুষের অবদান, গোলাপগঞ্জের সাহিত্য ও সাংবাদিকতা, বরণ্য ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাব্যবস্থা,দর্শনীয় স্থান,ঐতিহ্যিক স্থান ও ঐতিহ্য,ক্রীড়াঙ্গন,পীর আওলিয়া, শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণব ধর্ম, মন্দির আখড়ার বিবরণ, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ গোলাপগঞ্জের প্রবাসীদের নিয়ে আলোচনা বিস্তৃত।
গ্রন্থখানা পাঠের পর যে কোনো পাঠকের মনে হবে, গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য একটি অখণ্ড ইতিহাস ও আক্ষরিক দলিল।
ইতিহাস বর্ণনায় ভাষা আবেগ বর্জিত হওয়ায় পাঠক সাবলীল আমেজ ও পরিতৃপ্তি পাবেন। এতে ভাষাকে অযথা জটিল করা হয়নি, গতিহীনতার অভিযোগে পাঠকেরা লেখককে দায়ী করবেন না। পাঠানুক্রমিক আগ্রহ পূর্বাপর পাঠককে টেনে নেবে। মুক্তিযুদ্ধ পর্বে একটি প্রশংসনীয় কাজ বলে বিবেচিত হবে মুক্তিযোদ্ধাদের ইউনিয়ন ভিক্তিক নাম তালিকা এবং এফ এফ নম্বরযুক্ত করে লিপিবব্ধ করা। এধরনের চেষ্টা আমার জানা মতে অন্য কোনো ইতিহাস গ্রন্থে দেখিনি বা পড়িনি। পাঠক অবশ্যই লেখকের এ শ্রমকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করবেন।
গ্রন্থখানার নান্দনিক দিক নিয়ে আলাচনার পরও কিছু ত্রুটিবিচ্যুতিকে গুরুত্ব দিতেই হয়। কোনো গ্রন্থই ত্রুটিমুক্ত করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ইতিহাসের মতো তথ্যভিক্তিক গ্রন্থকে অভিযোগমুক্ত করা কঠিন। কিছু অসংগতি থাকতেই পারে ভাষা, তথ্য সন্নিবেশ, ধারাবাহিকতা এবং চিহ্নিত করার মতো অসংখ্য বিষয়কে সংযোজন করতে হিমসিম খেতেই হবে। লেখকও ইতিহাসের মর্মস্পর্শ করতে কোনো কোনো সময় দ্বিধান্বিত হয়েছেন। এই দ্বিধা বা সংকট প্রকট না হলেও পাঠককে স্পর্শ করবে। আগেই বলেছি, ইতিহাস আবেগ বর্জিত বর্ণনাভিত্তিক তথ্যের ভা-ার।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের পরিচিত ও নামকরণ পর্বে পাঠক ৫ ও ৬ নং ছত্রের মর্মার্থ এবং একটি শব্দ প্রয়োগ যথার্থ হয়নি বলে লেখককে সতর্ক করে দিতে পারেন। ছত্রটি “বঙ্গদেশ নামের উতপত্তির আগেও সিলেটভুক্ত অঞ্চলে সভ্য জনপদের অস্থিত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।” এখানে বঙ্গদেশ নামক দেশের উতপত্তির আগে সিলেট অঞ্চলে সভ্য জনপদের অস্থিত্ব বক্তব্যটি সঠিক নয় বলে পাঠক মনে করতে পারে। বঙ্গদেশ-এর জন্মের আগে বা অস্থিত্বের আগে সিলেট অঞ্চল ছিলো বলে লেখকের দাবী যৌক্তিক নয় পাঠক প্রশ্ন তুলতে পারেন। এখানে ঐতিহাসিক দৃষ্টি ক্ষুন্ন হয়েছে বলে পাঠক মনে করতে পারে। এবং সভ্য জনপদ ছিলো এটাও তথ্যসুত্রহীন ধরা স্বাভাবিক। সভ্য শব্দটির অর্থ ভিন্নতা নির্দেশ করে। সভ্য জনপদ না বলে শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিভাবে অগ্রসর জনপদ বলতে পারতেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার পর্বে দেশের অনেকগুনি জনের সাহায্য সহযোগিতার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখক নামউল্লেখ পুর্বক একটি স্মারকস্তুতি লিখে ঋণস্বীকার করেছেন।এরকম সম্মানদান ও ঋণ স্বীকার করার ফলে মূলত লেখকই সম্মানিক হয়েছেন। এতে লেখকের মুক্তমনকে উদ্ভাসিত করেছে,উদারতায় অভিষিক্ত হয়েছেন।
সবশেষে গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্য গ্রন্থখানা প্রাণিত ও নিনাদিত করে আরেকটি বার্তায়। যে বার্তাটি গর্বভরা একটি আলোকিত অঞ্চলের চিহ্নায়ন। বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে গোলাপগঞ্জ অঞ্চল হাজার বছরের সাস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। এখানে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা ও প্রচারক শ্রীচৈতন্যের পৈতৃকভূমি। গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণেই রয়েছে এই বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যদেবের আখড়া। তাঁর অনুসারি বৈষ্ণব কবিদের জন্মভূমিও গোলাপগঞ্জ। মানবতবাদী শ্রীচেতন্য শুধু মানব ধর্ম প্রচার করেননি, হিন্দু ধর্মের শ্রেণী ও বর্ণপ্রথাকে প্রত্যাখ্যান করে এক অহিংস ধর্ম প্রবর্তন করেন। যে নব জাগরণ বঙ্গদেশসহ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং এখনো আদৃত।
অন্যদিকে, গোলাপগঞ্জ অঞ্চল সাস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে এক উজ্জ্বল জনপদ। এ অঞ্চল কয়েক শত বছর ব্যাপী ধারাবাহিকভাবে শিক্ষায় অগ্রসর, উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণিবিদগ্ধজনের বসবাস। বৃটিশ আমলে সিলেট আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত হলে প্রশাসনিক উচ্চপদে গোলাপগঞ্জেরবাসীর প্রধান্য একচেটিয়া হয়ে যায়। এমনকি পাকিস্তান আমলেও সিএসপি অফিসার সর্বাধিক ছিলো গোলাপগঞ্জের। বর্তমান বাংলাদেশেও এই ধারাবাহিকতা অন্যান্য জেলার তুলনায় গোলাপগঞ্জের অবস্থান শীর্ষে।
গোলাপগঞ্জের ইতিহাস পাঠের পর শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রসর এ অঞ্চলের ইতিহাস রচনা ও পাঠ দুটিই যে কোনো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। বর্তমান গ্রন্থখানা এই অর্থে একটি লোভনীয় রচনাসমগ্র। তবে আসদ্দর আলীর ভূমিকা গ্রন্থের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়নি। অতি সাদাসিধে বাক্য ও মতামত পাঠককে অনুপ্রাণিত করবে না, বরং পীড়িত করবে।
আমরা জানি, বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস লিখেছেন পূর্বসুরী অচ্যুতচরণ চৌধুরী, মরতুজা আলী, আশরফ হোসেন, কমলাকান্ত গুপ্তসহ আরো অনেকে। এছাড়া ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙও তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে সিলেট অঞ্চলকে বিভিন্নভাবে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চিহ্নিত ও চিত্রিত করেছেন। বরার্ট লি-জেও সিলেটের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই বর্ণনা করেছেন প্রাপ্ত তথ্যসামগ্রী দিয়ে। আরো রয়েছে আসাম গেজেটিয়ার ও সিলেট ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার। সবগুলো বইয়ে বা দলিলে রয়েছে বিস্তর তথ্য। কিন্তু গোলাপগঞ্জ অঞ্চল নিয়ে আলাদা গ্রন্থ বলতে গেলে নেই। যা আছে তাও সম্মিলিত ও গুচ্ছবদ্ধ তথ্য কণিকার অভাব। সুতরাং সিলেট অঞ্চলের গোলাপগঞ্জকে নিয়ে আনোয়ার শাহজাহান যে গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন, এটি ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে অন্যতম একটি সংযোজন। তাঁর এ পরিশ্রম পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস অনুসন্ধানকে আরো শাণিত ও পরিশীলিত করবে। আনোয়ার শাহজাহানের পরিশ্রম স্বার্থক হউক, আদৃত হউক। আত্মানুসন্ধানে প্রেরণা যোগাক নিরন্তর।
লেখক: হামিদ মোহাম্মদ-কবি, গল্পকার ও সংস্কৃতিকর্মী।