দলীয় পদ-পদবী বিক্রি করেই ১২’শ কোটির মালিক!
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২০:২৪,অপরাহ্ন ১৪ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ১১৩৫ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ছিলেন সংগঠনটির অফিসের পিয়ন। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় নেতা বনে যাওয়া আনিস হয়ে গেছেন যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। যুবলীগের পদ পেয়ে কম করে হলেও তিনি ১২০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যাওয়ার মতোই রাজধানীতে ৪৬ ফ্ল্যাট-দোকানের মালিক হয়ে যান তিনি।
সূত্র থেকে জানা গেছে, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা কাজী আনিসের রাজধানীতে রয়েছে ২৩টি ফ্ল্যাট ও তিনটি বহুতল বাড়ি। বিভিন্ন মার্কেটে ২৩টি দোকান, পুঁজিবাজারে আছে ১৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। নারায়ণগঞ্জ জেলায় আছে একটি চটকল। রাজধানীর বাইরে ৩শ ২৫ বিঘা জমি। এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন প্রভাবশালী যুবলীগের শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায় থেকে। এই সম্পত্তির বেশিরভাগই যুবলীগের পদ বেচে করেছেন বলে জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন দলের শুদ্ধি অভিযান আরম্ভ হওয়ার পর অভিযোগগুলো সামনে আসায় তাকে আওয়ামী যুবলীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কাজী আনিসুর একসময় তিন হাজার টাকা বেতনের একজন গার্মেন্টকর্মী ছিলেন। ২০০৫ সালে চাকরি পান যুবলীগ কেন্দ্রীয় অফিসের পিয়ন হিসেবে। পিয়ন হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রভাবশালীদের ছায়ায় থেকে তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আসেন।
২০১২ সালে মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে যুবলীগের উপ দপ্তর সম্পাদক হন। এর মাত্র ছয় মাসের মাথায় দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন ও যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদবাণিজ্য করেই গড়েছেন বিপুল বিত্তবৈভব।
জানা গেছে, ক্যাসিনো, জুয়ার কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বহিরাগতরা তার হাত ধরেই পদ-পদবি নিয়েছেন যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে। তাদের প্রতিজনের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন আনিস। এসব অবৈধ উপার্জনের অর্থে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
তবে যুবলীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলছেন, পিয়ন থেকে ফুলেফেঁপে ওঠা আনিসকে যারা কেন্দ্রীয় নেতা বানিয়েছেন, তারা এর দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেন না।
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা কাজী আনিসুর রহমান আনিস গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ভাবড়াসুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত আনিস রাজধানীতে এসে গার্মেন্টে চাকরি নেন। কিন্তু এতে তার অভাব দূর না হওয়ায় চেষ্টা চলতে থাকে নিরন্তর। যোগ দেন যুবলীগ অফিসে পিয়ন হিসেবে। এর পর থেকে তার পাল্টে যাওয়ার গল্প রূপকথার মতো। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন তিনি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান ভূঁইয়া মাখন গণমাধ্যমকে বলেন, আনিসের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। এর পরই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আনিসের সম্পর্কে ময়মনসিংহ জেলার এক যুবলীগ নেতা জানান, একটি থানার সাধারণ সম্পাদকের পদ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে তার কাছ থেকে হাতিয়েছেন আট লাখ টাকা। এখন তিনি তার কোনো খোঁজই পাচ্ছেন না।
সূত্র জানায়, কোটিপতি আনিস আত্মগোপনে যাওয়ার আগে আওয়ামী যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ছাড়া কাউকে পরোয়া করতেন না। তার বেপরোয়া মনোভাবে যুবলীগ নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় অফিসে কোণঠাসা।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় অফিসে ২০০৫ সালে যখন আনিসের পিয়নের চাকরি হয়, তখন তিনি নেতাদের হুট ফরমায়েশ শোনার পাশাপাশি কম্পিউটার অপারেটরের কাজও করতেন। এই সুবাদে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি কার্যালয়ে আসা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও সখ্য হয় তার। আস্তে আস্তে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা নেতাদের দৃষ্টিতেও চলে আসেন আনিস।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তার বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, আনিসকে সবাই ‘ক্যাশিয়ার’ বলেই চেনে। তবে গত এক যুগে আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতোই তিনি শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। কিছু যুবলীগ নেতার সব ধরনের অপকর্মের সঙ্গী এই আনিস।
এ দিকে আনিসের বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গেল কয়েক বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় পাঁচটি ফ্ল্যাট, ধানমণ্ডির রায়ের বাজারে একটি বাড়ি, ল্যাবএইডের বিপরীতে ধানমণ্ডি ৪ নম্বর সড়কে ১৫ নম্বর ভবনে একটি ফ্ল্যাট, ৯/এ সড়কে ৫০ নম্বর বাড়িতে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এ ছাড়া ১০ নম্বর সড়কে ২২ নম্বর বাড়িতে আরেকটি (বি/১৩ নম্বর) ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করেন। এই ফ্ল্যাটটিও তার। এ ছাড়া স্বামীবাগে মিতালী স্কুলের গলিতে ৫৪ নম্বর বাড়িতে একটি, রামকৃষ্ণ মিশন রোড়ে ৭/২ হোল্ডিংয়ের বাড়িতে ৪টি, একই সড়কে ৭/১/সি হোল্ডিংয়ের বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
জানা গেছে, গুলশান-২-এ নাভানা টাওয়ারে ৩টি দোকান, উত্তরার রাজলক্ষ্মী ও রাজউক মার্কেটে ২০টি দোকান রয়েছে যুবলীগের এই বহিষ্কৃত নেতার। এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায় ১৭৫ বিঘা জমি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ইউএনও অফিসের পাশে ও কলেজ মোড়ে দুটি বাড়ি। মুকসুদপুরে মা ফিলিং স্টেশন, নিজ গ্রাম বোয়ালিয়ায় ১৫০ একর জমি কিনেছেন আনিস। সেখানে মাছের ঘের ও হাঁসের খামার করা হয়েছে। নিজ গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন আলিশান প্রাসাদ।
কাজী আনিসের নারায়ণগঞ্জে একটি চটকল আছে। ঢাকা ধানমণ্ডির শুক্রাবাদের ৮/২/এ ৭ তলা বাড়িটি পাঁচ কোটি টাকায় ক্রয় করলেও ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করে লিখে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ঢাকায় তার ৭টি অফিস রয়েছে।