স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা : মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক অভিনন্দনযোগ্য কাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫৫:০০,অপরাহ্ন ১৩ অক্টোবর ২০১৬ | সংবাদটি ১৮২২ বার পঠিত
আখতার হুসেন
স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা (প্রথম খন্ড) : আনোয়ার শাহজাহান ॥ প্রকাশক : বইপত্র, ৯ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০ ॥ প্রকাশকাল : বইমেলা ২০১৬ ॥ প্রচ্ছদ : অনন্ত আকাশ ॥ পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৩১২ ।। মূল্য : ৬০০ টাকা ॥
ভূমিকাস্বরূপ ‘লেখকের কথা’য় এ বইয়ের লেখক আনোয়ার শাহজাহান যথার্থই বলেছেন, ‘অপ্রিয় হলেও সত্য যে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতার পরও এখনো আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটি নির্ভুল ও চূড়ান্ত করতে পারিনি। পারিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের চিহ্নিত করার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের তালিকাটি তৈরি করতেও। এমনকি খেতাবপ্রাপ্ত মাত্র ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি দেশ স্বাধীনের প্রায় পাঁচ দশকের কাছাকাছি সময়েও আমাদের কোনো লেখকের পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। জাতি হিসেবে এটা অবশ্যই আমাদের দেউলিয়াত্বের আরেকটি বড় লক্ষণ। মূলত এই অপূর্ণতাগুলোই আমাকে বইটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করে।’
আলোচনার শুরুতেই লেখকের অজুহাতস্বরূপ এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরার কারণটা এই যে, লেখক আনোয়ার শাহজাহান নিছক কথার ফুলঝুরি ঝরাননি। সত্যিই তো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যে দীর্ঘ অধ্যায়ের সূচনা হয়, তা-ই মূলত সঠিক ইতিহাস রচনা করতে দেয়নি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার বীরযোদ্ধা তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস, আর প্রায় পাঁচ দশক ধরে এ সম্পর্কে যা-কিছু রচিত হয়েছে, হয় তা ভূলসর্বস্ব, বিকৃত, নয়তো খন্ডিত। পূর্ণাঙ্গ তো দূরের কথা, এ-সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য ইতিহাসও বিরলপ্রায়। এখনো। তাই লেখক আনোয়ার শাহজাহান এ নিয়ে যখন ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তখন তাঁকে অভিনন্দিত না করে পারি না।
‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রথম খন্ড যখন আমার পাঠের নাগালে আসে, তখন সত্যিই আমার আনন্দের পরিসীমা ছিল না। আনোয়ার শাহজাহান সত্যিকার অর্থেই সেই গবেষকদের অন্যতম, যাঁর গবেষণার মূল বিষয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি যখনই যে গ্রন্থ রচনা করেন, সেটা করেন তার আদ্যোপান্ত জেনেই, তথ্যের সমাহারে ফাঁকির বিন্দুমাত্র অবকাশ না রেখে। বস্তুত প্রকৃত ও ধীমান গবেষকের সেটাই চরিত্র। ঠিক এই পেক্ষাপট বিচারে আমরা যখন আমাদের এই গ্রন্থের আলোচনায় ব্রতী হই, তখন দেখি, আনোয়ার শাহজাহানের আলোচ্য গ্রন্থ সব দিক থেকেই অদ্বিতীয় এক গ্রন্থ। কেননা, একই বিষয়ে আরও দু-তিনটি গ্রন্থ আমার দেখার ও পড়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সেগুলো এতই অসম্পূর্ণ, এতই ভুলে ভরা এবং এতটাই অযর সঙ্গে মুদ্রিত ও প্রকাশিত যে, কিছুদূর অগ্রসর হয়েই আর পড়তে ইচ্ছে করে না। অথবা বলতে হয়, ওপরে উল্লেখিত কারণগুলো আমাদের সেসব গ্রন্থ পড়া থেকে মাঝপথেই বিরত হতে বাধ্য করে।
গবেষক হিসেবে আনোয়ার শাহজাহানের কৃতিত্বটা এখানেই যে, তিনি শুরু করতে জানেন এবং যথাযথভাবে শেষও করতে জানেন। ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ (প্রথম খন্ড) গ্রন্থে জায়গা করে নিয়েছেন মোট তিনটি ক্যাটাগরির খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ। ক্যাটাগরি তিনটি হচ্ছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘বীর-উত্তম’ ‘বীরবিক্রম’। এই তিন ক্যাটাগরিতে পড়া প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি তিনি যখন তুলে ধরছেন, তখন সত্যিই অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত তথ্যের সার্বিক দুষ্প্রাপ্যতা যেখানে প্রকট, সেখানে তিনি বর্তমান খন্ডে তিনটি ক্যাটাগরির খেতাবপ্রাপ্ত ২৪০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিবরণ তুলে ধরছেন অসম্ভব যত্নের সঙ্গে, তাঁদের জীবনের নানা খুঁটিনাটিসমেত। আমার পড়া একই শ্রেণিভুক্ত অন্যান্য গ্রন্থে যে বিবরণ এলোমেলো, ভুলে ভরা, তাঁদের বেশির ভাগেরই জন্মসালের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এই গ্রন্থে গবেষক আনোয়ার শাহজাহান সেদিকটি যথাসম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন।
এ গ্রন্থে বড় আলোচনার বিষয় হচ্ছে আনোয়ার শাহজাহানের বিবৃত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনী। অনুপম ভাষায় তাঁদের বীরত্বগাথা যেভাবে, যে ভাষাভঙ্গি বা শৈলীসহযোগে তিনি তুলে ধরেছেন, এককথায় তা অতুলনীয়। যেখানে যতটুকু তথ্য পেয়েছেন, প্রয়োজনীয় জায়গায় তা তুলে ধরতে তিনি কসুর করেননি। এটাই লেখকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের জায়গা। মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বীর-উত্তম তাঁর ভূমিকায় বলেছেন, ‘এ বইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতিপর্বে সংক্ষিপ্তাকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য রোমাঞ্চকর কাহিনি উঠে এসেছে। এগুলো অনেক কল্পকাহিনিকেও হার মানায়, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে। এ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে আরেক গ্রহণযোগ্য ইতিহাস লিখতে অনুপ্রাণিত করবে, প্রেরণা জোগাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা নিয়ে কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক লিখতে, চলচ্চিত্র তৈরি করতে।’ যথার্থ তাঁর আশাবাদ, যথার্থ তাঁর মন্তব্য-ভাষ্য এ বইয়ের লেখক সম্পর্কে।
এ বইয়ের তিনটি অধ্যায় শুরু হয়েছে খেতাব-সংশ্লিষ্ট পদকের ছবি ও বর্ণনা দিয়ে। পরিশিষ্টাংশে উল্লেখ করা হয়েছে বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত সেই সব মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে, যাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তার পরই উল্লেখ করা হয়েছে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু নামের তালিকা (সম্ভবত দ্বিতীয় খণ্ডে তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লেখা হবে)। শুধু তা-ই নয়, উল্লেখ করা হয়েছে এ বইয়ে ব্যবহৃত সংকেতের বিশ্লেষণ। সেই সাথে তুলে ধরা হয়েছে ‘সংক্ষিপ্ত পরিচিতি’র নমুনা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টরগুলোর পাশাপাশি আছে সহায়ক গ্রন্থপঞ্জির বিবরণ। গ্রন্থপঞ্জির তালিকাটি সংক্ষিপ্ত নয় মোটেও। পরিশেষে আছে নির্ঘণ্ট, এ গ্রন্থের জন্য যা অপরিহার্য বলে বিবেচিত।
বিদেশের মাটিতে বসে আনোয়ার শাহজাহান একজন নিরলস গবেষক হিসেবে যে অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে চলেছেন, সে জন্য তাঁকে প্রশংসাবাক্যের মাধ্যমে উৎসাহিত করার পাশাপাশি প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাতে হবে। দেশবাসীর পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ (প্রথম খন্ড) গ্রন্থের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং অধীরভাবে অপেক্ষা করছি তাঁর রচিত একই শিরোনামের গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে জন্য।
আখতার হুসেন : বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক ও শিশু সাহিত্যিক।