আমেরিকায় সাম্প্রতিক বিক্ষোভ,ভাংচুর,লুট ও একটি পর্যালোচনা
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:১৫:১৩,অপরাহ্ন ১২ জুন ২০২০ | সংবাদটি ৬৬৪ বার পঠিত
।। জাহেদ জারিফ ।।
বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে ভাংচুরের একটি সমান্তরাল মিল রয়েছে।বিক্ষুব্ধ জনতা যখন বিক্ষোভের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয় তখনই তারা মিডিয়া ও কর্তৃপক্ষের টনক নাড়াতে ভাংচুরের আশ্রয় নেয়।ক্ষেত্রবিশেষ সফলও হয়। বিক্ষোভের আলোচনায় ভাংচুর বিষয়টি অবধারিতভাবে চলে আসলেও লুটতরাজ আসে অনাকাঙ্খিতভাবে।যদিও বিক্ষোভ ও ভাংচুরের সাথে লুটের কোন আদর্শিক মিল নেই, তথাপি আন্দোলন,বিক্ষোভের সাথে কিছু সুযোগ সন্ধানী লুটেরা মনের মানুষ লুটের কাজটাও সারে।বিক্ষোভ ও আন্দোলনে কেনো মানুষেরা লুটের মতো হীনরুচির কাজ করে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনস্তত্ত্বাত্বিক বিশ্লেষণ আছে।সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি।সম্প্রতি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় এবং পর্যায়ক্রমে পুরো বিশ্বে বর্ণবাদবিরোধী যে বিক্ষোভ দাবানলে রূপ নিয়েছে তা নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘ বঞ্চনার অনিবার্য প্রকাশ। মানুষের হৃদয়ে পুনজিবীত মনস্তাপ যখন সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে তখন তা বিক্ষোভে রূপ নেয়।অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, শোষিত ও প্রতারিত জনতা তাদের নায্য অধিকার আদায়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যখন কোন উপায়ান্তর পায়না তখনই তারা বিক্ষোব্ধ হয়ে উঠে।অধিকার আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র বিক্ষোভের পথই তাদের বেঁচে নিতে হয়। কর্তৃপক্ষও বিক্ষোব্ধ জনতাকে ধমিয়ে রাখার প্রাণান্তর প্রয়াস চালায়। তাদের বিক্ষোভকে ধমিয়ে দিতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে।আমেরিকা প্রশাসনও তার ব্যতিক্রম নয়।তারাও বিক্ষোভী মানুষকে ধমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে, জর্জ ফ্লয়েডের করুণ মৃত্যুতে পুরো বিশ্বের বিবেকী মানুষের অকুন্ঠ সমর্থনই তার প্রমাণ।লকডাউন অমান্য করে বৃটেনে ট্র্যাফালগার স্কোয়ার,জার্মানের বার্লিনে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও, ফ্রান্সের প্যারিসে কালো পোষাক ও মুখোশ পরে “আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা, আমরা সবাই জর্জ ফ্লয়েড” স্লোগানে মুখরিত করে। ডেনমার্কে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোব্ধ জনতার মুখে উচ্চারিত হলো”কোন ন্যায় বিচার নেই,শান্তিও নেই”স্লোগান।একইভাবে করোনা ভয়কে পায়ে ঠেলে ইতালি, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড,সিরিয়া,মেক্সিকো,কানাডা, পোল্যান্ড সহ আরো অনেক দেশই এই বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
ওয়াশিংটন ডিসি নগর কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদস্বরুপ হোয়াইট হাউসমুখী একটি ব্যস্ত রাস্তায় (১৬তম স্ট্রিটের দুটি ব্লক) বিশাল হলুদ বর্ণে সতর্কবার্তা এঁকে দেয় “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” এবং ঐ রাস্তাটিতে নতুন সাইন বসানো হয়-ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজা”। অন্যায় অবিচারে নিষ্পেষিত মানুষ বিক্ষোভের সাথে সাথে কেনো ভাংচুরের মতো অগ্রহণযোগ্য পথ বেঁচে নেয় তারও একটি গ্রহণযোগ্য কারণ আছে।মেরিল্যান্ডে ২৫বছর বয়সী আফ্রিকান আমেরিকান ফ্রেডি গ্রে ২০১৫ সালে পুলিশি হেফাজতে তার ঘাড় ও মেরুদন্ডে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শেষোবদি কোমায় মৃত্যুবরণ করেন।মেরিল্যান্ডের কৃষ্ণাঙ্গরা এই অবিচারের প্রতিকার চেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে কিন্তু তারা কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে ব্যর্থ হয়।পরে বাধ্য হয়ে তারা নিকটস্থ সিভিএস ফার্মাসিতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভাংচুর-অগ্নিকান্ডের সাথে সুযোগ সন্ধানী লুটেরাগোষ্ঠী লুটপাটও করে।পরে প্রশাসনসহ মিডিয়ার চৈতন্য হয়। শুধু গায়ের চামড়ার রং দেখে ইচ্ছাকৃতভাবে সংগঠিত এইসব প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ এখনো থামেনি। সময়ের বাঁকে বাঁকে শ্বেতাঙ্গদের রোষানলে পড়ে এই ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের স্বীকার অশেতাঙ্গরাই বেশি হচ্ছেন। আহমদ আরবেরি, জর্জ ফ্লয়েড, টনি ম্যাকডেড, ব্রেনোটা টেলরের করুন মৃত্যু আমাদেরকে, বিশ্ববিবেক কে সাময়িক ভাবিয়েছে, পীড়া দিয়েছে। কিন্তু এই জঘন্যতম কাজের উপযুক্ত ও স্থায়ী প্রতিবিধান মেলেনি। বর্ণ বৈষম্যের কাছে বারবার পরাস্ত হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার।
জর্জ ফ্লয়েডের ঘাতক ডেরেক চৌভিনকে থার্ড ডিগ্রি মার্ডার ও ম্যানশ্লোটার আইনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছ।আমেরিকার মাত্র তিনটি স্টেট পেনসেলভেনিয়া, ফ্লোরিডা, মিনেসোটাতে এই আইন প্রচলিত আছে। ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের পরেই আসে সেকেন্ড,থার্ড ডিগ্রি মার্ডার সহ ম্যানশ্লোটার অভিযোগ।কোন মানুষ যদি ইচ্ছাকৃত ও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কোন মানুষকে খুন করে তখন তাকে ফার্স্ট ডিগ্রী মার্ডারে অভিযুক্ত করা হয় যার শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদন্ড।সেকেন্ড ডিগ্রী মার্ডার হলো যখন কোন মানুষ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন মানুষের প্রাণনাশ করে যেমন আপনি দেখলেন আপনার বান্ধবী আপনাকে প্রতারিত করে অন্য একজনের সাথে গোপন সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে।দেখামাত্র আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে শায়েস্তা করার জন্য হাতে যা পেলেন তা দিয়েই আঘাত করলেন,অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখা গেলো সে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।এই ধরনের অপরিকল্পিত হত্যাকে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারে অভিযুক্ত করা হয় যার শাস্তি হলো অনধিক ৪০বছরের জেল।ডেরেক চৌভিনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি কতো মামুলী হবে তা আপনারা ইতোমধ্যে অনুমান করতে পারছেন।থার্ড ডিগ্রি মার্ডার হলো যা ফার্স্ট ও সেকেন্ড ডিগ্রির আওতায় পড়েনা।অর্থাৎ অসাবধানতাবশত বা দূর্ঘটনাবশত কারো হাতে যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন তখন খুনিকে থার্ড ডিগ্রী মার্ডারে অভিযুক্ত করা হয়।থার্ড ডিগ্রী মার্ডারে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি হলো অনধিক ২৫ বছরের জেল।ম্যানশ্লোটার হলো খুন সংক্রান্ত আলোচ্য তিনটি পর্যায়ের মধ্যে একেবারে নগন্য একটি অভিযোগ।ম্যানশ্লোটারে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি হলো ১৫ বছরের জেল এবং ৩০০০০ডলার জরিমানা।যা আমেরিকার তিনটি স্টেট ব্যতিত অন্য কোন স্টেটে নেই।একজন মানুষের জীবনকে কতো তুচ্ছ কতো অর্থহীন বিবেচনা করা হলে এমন অভিযোগে খুনিকে অভিযুক্ত করে একটি প্রহসনের শাস্তি বিধান করা হয় ভাবতেই গা শিউরে উঠে।পুরো আমেরিকা সহ বিশ্বের বিবেকী মানুষ ফুসে উঠার কারণও হলো এই প্রহসনের বিচার।বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে এবার আসি কেনো মানুষ বিক্ষোভে লুটের মতো হীন কাজে লিপ্ত হয় সেই আলোচনায়।জুলুম,নির্যাতন শোষনের বিরুদ্ধে জড়ো হওয়া জনতার মধ্যে ভাংচুর হয় এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।তবে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় জড়ো হওয়া বিক্ষোব্ধ জনতা লুটতরাজে জড়াবে সমাজবিজ্ঞানীরা তা বিশ্বাস করেন না।কারণ বিক্ষোভকারী ও লুটেরাদের মধ্যে মনস্তাত্বিক এবং আদর্শগত পার্থক্য রয়েছে।লুটেরা কখনো বিক্ষোভকারী নয় তেমনি বিক্ষোভকারীও লুটেরা নয়।মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ডানা ফিশার বিশ বছর ধরে বিক্ষোভ বিশ্লেষণ ও অধ্যয়ন করে আসছেন,তিনি মনে করেন প্রতিবাদকারীদের পক্ষে এলোপাতাড়ি চুরি লুট একেবারেই বিরল ঘটনা।মানুষ ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বিক্ষোভকারীদের দলে ভিড়ে এবং সুযোগ বুঝে চুরি ও লুট করে।জর্জ ফ্লয়েডের করুণ মৃত্যুতে ন্যায় বিচার চেয়ে আমেরিকাজুড়ে চালিত বিক্ষোভে চুরি ও লুটতরাজের মতো অত্যন্ত গর্হিত কাজ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।লুটেরা ও শান্তিকামী মানুষের মধ্যে পার্থক্য টেনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের সমর্থন ও শক্তি যোগান দিতে হবে। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
জাহেদ জারিফ, নিউইয়র্ক।