করোনার করুণ সময় ও বাস্তবতা
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০২:২৯,অপরাহ্ন ১৪ মে ২০২০ | সংবাদটি ৬৩৬ বার পঠিত
।। জাহেদ জারিফ ।।
করোনার আঘাতে বিশ্বের সদাব্যস্ত নির্ঘুম শহরগুলো এখন থমকে যাওয়া একেকটি ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে।মৃত্যুর ভয়ে মানুষের জীবন জীবিকা স্থবির,নিশ্চল,পানসে।বিশ্বের সকল শহরগুলোই এখন আর আপন জৌলুসে নেই।স্বজন হারানোর বেদনায় মানুষের হৃদয় ভারাক্রান্ত।তার সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব।ফলে দেশে দেশে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।আকাশ পথেও স্থবিরতা ভর করেছে,হোটেল পর্যটন,ব্যবসা বাণিজ্য সব কিছুই বন্ধ।এগুলো যেকোন মন্দা ও মহামারীকালিন অতি সাধারণ চিত্র।
গত শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা হয়েছিলো ১৯২৯-১৯৩৯ সালে যা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম মন্দা।বৈশ্বিক এই মন্দার নেতিবাচক প্রভাবের কারনে একে বৈশ্বিক মহামন্দা বলে আখ্যায়িত করা হয়।মন্দাকালের কিছু সর্বজনীন বৈশিষ্ট আছে,যেমন ক্রমবর্ধমান অস্বাভাবিক বেকারত্ব,উৎপাদন হ্রাস,চাহিদার নিম্নগতি,খাদ্য সঙ্কট,মুদ্রাস্ফীতি,ঋণ সঙ্কট,ব্যবসা বাণিজ্যে দেউলিয়াত্ব ইত্যাদি।বর্তমান করোনা মহামারী মন্দাকালীন অন্যান্য সব বৈশিষ্ট্য সহ এক অভূতপূর্ব রৌদ্ররুপ নিয়ে বিশ্বে হাজির হয়েছে যা ইতোপূর্বে মানবজাতি আঁচ করেনি।ছোঁয়াচে রোগটি মানুষের মাধ্যে তার সংক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখেনি,তা ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণীকূলের মধ্যেও।নিউইয়র্কস্থ ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত কয়েকটি প্রাণীর মধ্যে এই ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছে।উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার জায়গাটি হলো,যেসব দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ উপকরণ ও জনবল নেই সেইসব দেশ তাঁর নাগরিকদের উপযুক্ত সেবা দেয়ার পাশাপাশি কিভাবে প্রাণীকূলের সুরক্ষামান নিশ্চিত করবে! ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে করোনা প্রতিরোধ একটি দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।সম্প্রতি বেইজিংয়ের পিপলস লিবারেশন আর্মি হাসপাতালের ডা ওয়েইগুও ঝাও এর নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রমাণ করেন,সংক্রমিত পুরুষের বীর্যে তারা করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পেয়েছেন।
গবেষক দল ৩৮ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ছয় জনের বীর্যে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।এই ছয় জনের মধ্যে চার জন আক্রান্ত অবস্থায় এবং বাকী দুজন সংক্রমন থেকে সেরে উঠার পর্যায়ে ছিলেন।সুতরাং এই গবেষণা থেকে সহজে অনুমেয় করোনা ভাইরাস কেবল মানব সভ্যতাকে দারিদ্র্যপীড়িতই করবে না সেই সাথে আমাদের সামাজিক জীবনেও আনবে অনাকাঙ্খিত বহু পরিবর্তন।করোনা ভাইরাস ধনী,গরীব,অখ্যাত বিখ্যাত সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে বাচবিচার না করেই করায়ত্ব করছে।অনুন্নত,উন্নত,উন্নয়নশীল সব দেশই বর্তমানে করোনার কাছে নতজানু,ধরাশায়ী।চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে করোনা নামক রহস্যজনক প্রাণঘাতী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের প্রতিষেধকের অশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছে পুরো মানবজাতি।
করোনা ভাইরাস এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যে বিভ্রান্তি ও গোলকধাঁধার মধ্যে রেখেছে তাতে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে আমাদেরকে হয়তোবা এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সাথে মানিয়ে চলতে এবং অভ্যস্থ হয়ে যেতে হবে।ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি এবং সংক্রামক রোগের প্রধান ডা অ্যান্থনি ফাউসি গত মার্চ মাসে বলেছিলেন একটি ভ্যাকসিন সম্ভবত এক বছর থেকে ১৮ মাসের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।তবে প্রতিরোধক আবিষ্কারে ডা ফাউসির সম্ভাব্য আশার বাণীতে বিশেষজ্ঞ মহলের সন্দেহ রয়েছে।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্হ্য সুরক্ষা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডা আমেশ আদালজা প্রতিষেধক আবিষ্কারে সম্ভাব্য সময়সীমা ১৮ মাসের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বলেন ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কয়েক মাস নয় বরং কয়েক বছর সময় হিসেব করতে হবে।অতীত মহামারী ও নানা প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ডা আমেশ আদালজার দাবিতেই আপনাকে আশ্বস্ত হতে হবে।বিশ্বে এখনো অনেক রোগ রয়েছে যেগুলোর প্রতিষেধক বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেন নি।
বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্খার হিসেব অনুযায়ী বিশ্বময় বছরে প্রায় ৪০০,০০০মানুষকে যে রোগ সংক্রমিত করে সেই ডেঙ্গু জ্বরের কার্যকর কোন প্রতিষেধক এখনো বিজ্ঞান আমাদেরকে দিতে পারেনি!১৯৮৪ সালে ওয়াসিংটন ডিসিতে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছিলো বিজ্ঞানীরা এইচআইভি ভাইরাসটি সফলভাবে সনাক্ত করতে পেরেছেন এবং এটির প্রতিরোধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিলো দুবছর।এইচআইভির ভ্যাকসিনের আশা বিশ্ববাসীকে হতাশ করেছে।
এখনো বিশ্ববাসী এইচআইভির ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় রয়েছে! সংক্রামক মহামারী কিভাবে তার পরিসমাপ্তি টানে?প্রশ্নটি ভুক্তভোগী মানুষের চোখের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।সবাই জানতে চায় কবে করোনা মহামারীর সমাপ্তি ঘটবে।কবে মানুষ এই মৃত্যুযজ্ঞ থেকে পরিত্রাণ পাবে।ঐতিহাসিকদের মতে যেকোন মহামারীর পরিসমাপ্তি দুটি উপায়ে হতে পারে।প্রথমত চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।চিকিৎসার মাধ্যমে সংক্রমন ও মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ার মধ্য দিয়ে স্থায়ীভাবে মহামারীর ইতি ঘটতে পারে।
দ্বিতীয়ত সামাজিক মাধ্যম।সামাজিক প্রক্রিয়ায় সচেতনতার মাধ্যমে জনসাধারণের মনে উদ্ভূত মহামারী সম্পর্কে ভয়ভীতি যখন কমে যাবে অর্থাৎ মানুষ যখন মহামারীর সাথে স্বাভাবিকভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে,মানিয়ে নিতে শিখবে তখনই মহামারীটি আপনাআপনিই অদৃশ্য ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।
করোনা মহামারীর পরিসমাপ্তির প্রশ্নে আমরা কোন প্রক্রিয়ার দিকে এগুচ্ছি তা আপাতত কোন দৈবজ্ঞ নয় বরং সময়ই বলে দিবে।
লেখক: সংগঠক, নিউইয়র্ক।