এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৫৭:২৫,অপরাহ্ন ১১ মে ২০২০ | সংবাদটি ৩৩৭ বার পঠিত
এখন এমন একটি সময় যখন মানুষজন করোনা ভাইরাস ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলছে না। এর মাঝেই পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ ঘরের ভেতর স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে থাকছে। এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন ঘর থেকে বের হয়ে আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে। কতোখানি আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবে, সেটা নিয়েও অনেকের ভেতর সন্দেহ।
ঘর থেকে বের হলেও হয়তো মুখে মাস্ক লাগিয়ে বের হতে হবে, একজন থেকে অন্য জনের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে থাকতে হবে, শুধু তাই নয়, কে জানে হ্যান্ডশেক জাতীয় বিষয়গুলো পৃথিবী থেকেই উঠে যাবে কী না! সেগুলো হচ্ছে ভবিষ্যতের ব্যাপার, আপাতত আমরা অপেক্ষা করছি কখন এই ভয়াবহ দুর্যোগটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে আসে।
এটা একটি যুদ্ধ, যারা যুদ্ধ দেখেছে তারা জানে সেটি কী ভয়ানক একটি ব্যাপার। যখন যুদ্ধ চলতে থাকে তখন সেটি এক ধরনের বিপর্যয়, যখন যুদ্ধ শেষ হয় তখন সেটি অন্য এক ধরনের বিপর্যয়। মনে হতে পারে এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ বুঝি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস! আসলে সেই ভাইরাসটি প্রতিপক্ষ নয়, এই ভাইরাসটি যতক্ষণ শরীরের বাইরে থাকে ততক্ষণ একটি জড় পদার্থ ছাড়া কিছু না। কোনোভাবে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারলে সেটি তার জীবন ফিরে পায়। যে প্রক্রিয়ায় একটি ভাইরাস মানুষের শরীরে তার বংশ বৃদ্ধি করে কিন্তু তার আয়ু দুই সপ্তাহের মত, এর মাঝেই বেশিরভাগ মানুষ শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ভাইরাসটিকে পরাস্ত করে ফেলে। বয়স্ক, রুগ্ন, দুর্বল, রোগাক্রান্ত কিংবা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের কেউ কেউ মারা যান। সব নিয়মেরই ব্যাতিক্রম থাকে, এই নিয়মেরও ব্যাতিক্রম আছে তাই মাঝে মাঝে আমরা দেখি কমবয়সী সুস্থ সবল যুবারাও মারা যাচ্ছেন।
শতাংশের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যাটি হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু এই ভাইরাসের সংক্রমণটি এতো ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে যে, এতো অসংখ্য মানুষ এতো তাড়াতাড়ি আক্রান্ত হয়ে যায় যে, হঠাৎ করে দেখা যায় অনেক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
এটি যদি যুদ্ধ হয়ে থাকে এবং সেই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ যদি ভাইরাসটি না হয়ে থাকে তাহলে প্রতিপক্ষটি কে?
আমরা এখন সবাই জানি প্রতিপক্ষ হচ্ছে থমকে যাওয়া পৃথিবীতে আশ্রয়হীন, সহায়-সম্বলহীন, দিন আনে দিন খায় মানুষের অনিশ্চিত জীবন। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে যতদিন থমকে যাওয়া দেশ আবার সচল না হচ্ছে ততদিন এই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে সচল রাখা, তাদেরকে মানুষের সম্মান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। এবারের যুদ্ধ হচ্ছে কর্মহীন, অসহায় দরিদ্র মানুষ রক্ষা করার যুদ্ধ, যাদের জন্য “সামাজিক দূরত্ব” নামের কথাটিই একটি বিলাসিতা।
যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হচ্ছে ততদিন একজন মানুষ আরেকজনকে আক্রান্ত করেই যাবে। যদি সেটা হয় নিয়ন্ত্রণের মাঝে, খুব ধীরে ধীরে তাহলে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।
সবাই মিলে সামনের দিনগুলোর জন্য খুব চিন্তা ভাবনা করে একটা পরিকল্পনা করতে হবে যেন দেশের মানুষ এই বিপর্যয়ের মাঝে টিকে থাকতে পারে। করোনা ভাইরাসের কারণে আজ কাপঁছে সারা পৃথিবী কোনো টাকা পয়সা শক্তি – সামর্থ্য কিছুই কাজে আসছে না। সামান্য এই ভাইরাসের কাছে আজ অসহায় মানুষ। সারা বিশ্ব করোনার ত্রাসে কেঁপে উঠেছে যেন না দেখা না চেনা বায়োলজিক্যাল ওয়্যার। কী ভয়ানক এই যুদ্ধ। কেউ কার শত্রুকে চিনে না। তবে এত বড় যুদ্ধ এত কঠিন যুদ্ধ বোধ হয় আগে কোন মানুষকে লড়তে হয় নি। যে যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে চোখে দেখা যায় না। যে যুদ্ধে গুলি, বোমা, রকেট লঞ্চার এমনকি কোন পারমাণবিক অস্ত্র ও কার্যকর হয় না। অথচ যে যুদ্ধে আণুবীক্ষণিক মরণ প্রতিপক্ষ করোনাভাইরাসটির মুখোমুখি হতে হচ্ছে নিরস্ত্র মানুষকে। না ঠিক নিরস্ত্র ও নয়। বরং সাবান পানি, স্যানিটাইজার মাস্ক, অক্সিজেন, আর পরিক্ষামুলক কিছু প্রচলিত ঔষধ দিয়ে এই অসম যুদ্ধটি স্থায়ী অস্থায়ী হাসপাতালে লড়তে হচ্ছে হাজার হাজার ডাক্তার নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীকে।
আমরা সবাই বর্তমান নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলা উচিত এখন। খুব কঠিন লড়াই এসেছে এখন। কঠিন লড়াই লড়তে হবে সবাইকে। এই লড়াইয়ের অস্ত্র হলো প্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
যুদ্ধকালীন সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ মানুষের মনোবল। করোনা ভাইরাসের এই বিপর্যয়টি সামলে নেওয়ার বিষয়টি যদি সত্যি একটি যুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে এবারেও আমাদের মনোবল রক্ষা করতে হবে। দেশের পুরো মানবসম্পদ যদি সাহস নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে নিশ্চয়ই এবারেও আমরা এই কঠিন সময়টি পার করতে পারবো।
মানুষ মানুষের জন্য-এর চাইতে বড় সত্যি কথা আর কী আছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় লন্ডভন্ড দুনিয়া লকডাউনে নীরব নিথর। মৃত্যুর সঙ্গে মানুষ লড়ছে। রাত-দিন জেগে থাকা সব পথ শহর নগর এখন জনশূন্য-ফাঁকা। স্বজনহীনভাবে পৃথিবী থেকে কী মর্মান্তিক বিদায়! শোকস্তব্ধ পৃথিবী শোক করতেও ভুলে গেছে। বেঁচে থাকার আকুতিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথাও ভুলে গেছে দুনিয়া! মানুষ এখন বাঁচার আশা নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছে। তবু মানবতাই মানুষের ধর্ম। পৃথিবীর সব কাজ থেমে গেছে। একটাই যুদ্ধ, জীবন বাঁচানোর। নিজে বাঁচার। দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে। মানবতার লড়াইয়ে একাত্তরের মতো এক মোহনায় মানুষ। তখন শত্রু ছিল দৃশ্যমান, এখন অদৃশ্য। শত্রু একটাই- শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সমস্ত পৃথিবীর একটা মহাশক্তিধর জীবাণু করোনাভাইরাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় বিপদেই দিতে হয়। এখনই আপনাদের দেওয়ার সময়। আর গুজব সৃষ্টি করবেন না, সরকার নয়, মানুষ ক্ষমা করবে না। মুনাফাখোর হবেন না। শুধু সরকার নয়, জনগণের রোষ থেকেও বাঁচবেন না। এই যুদ্ধ মানুষের জীবন রক্ষার। এ যুদ্ধে জিততেই হবে।
এই যুদ্ধ এখন রুম আর ডাইনিংয়ে দৌড়। বাতাসে জীবাণু তাই জানালা খুলে আকাশ দেখি না। সবকিছুই অসহ্য লাগে। চন্দ্রস্মিতা আহ্লাদি করে। মনে করে আমার শিক্ষাঙ্গন বন্ধের লেখালেখির কারণে তার স্কুলসহ সব বন্ধ আজকের এই বন্দীজীবন অসহ্য। কত অসহায় আজ। এই করোনাভাইরাস প্রকৃতির অভিশাপ নাকি কোনো সুপার পাওয়ারদের সৃষ্টি সে নির্মম সত্যও এক দিন পরিষ্কার হবে। কবে মুক্তি, কবে বের হব, বুকভরে শ্বাস নেব তাও জানি না। তবু এর বিকল্প নেই। আল্লাহকে ডাকি। শোকরিয়া আদায় করি আক্রান্তদের কথা ভেবে। সকল মানবের নিরাপদ জীবন চাই। এমন পৃথিবীর আঁধার মুখ দেখব বুঝিনি। প্রিয়জনের মেজাজি চেহারা, কালো আঁধার বিরক্তিকর কত কিছু আজ পৃথিবীর এ ভয়ার্ত অসহায়ত্বের অশ্রুজলে ভেসে গেছে। কেবল বেঁচে থাকা, বুকভরে শ্বাস নেওয়ার প্রবল ইচ্ছেই জাগে। মানুষের কাছে জীবাণুমুক্ত দেশে আড্ডায় ডুবতে ইচ্ছে করে। জানালার বাইরে তাকিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিকে দেখে আমার চেয়ে সুখী মনে হয়। লকডাউনে দূষণমুক্ত পৃথিবী এখন দেখছে আমাদের পাপের শাস্তি। অসহায়ত্ব।
লেখক: কবি