বাংলাদেশী বাবার খোঁজে ঢাকার অলিগলিতে এক ব্রিটিশ যুবক
প্রকাশিত হয়েছে : ২:০৫:২০,অপরাহ্ন ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ২৩৫১ বার পঠিত
টানা ১০ দিন ধরে পুরান ঢাকার অলিগলি আর ভাঙা রাস্তায় ছুটেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ নাগরিক জেমি হেনশ্যাল। সোয়াব আলী নামে এক লোককে খুঁজেছেন তিনি। সোয়াব আলী তাঁর হারিয়ে যাওয়া বাবা।
মা ক্লারা হেনশ্যালের কাছে জেমি শুনেছেন, বাবার আদি নিবাস পুরান ঢাকায়। ৩১ বছর আগে যুক্তরাজ্য ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন সোয়াব আলী। আর ফিরে যাননি। জেমি তখন কোলের শিশু।
সোয়াব আলী সম্পর্কে বেশি কিছু জানেন না জেমি। জানেন না ঠিকানা। শুধু নাম আর বাবার দুটি পুরোনো ছবি সম্বল করে পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে বেরিয়েছেন ৩৪ বছরের যুবক জেমি। তাঁর এখনকার নিবাস অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে। সেখানে তিনি আলোকচিত্রী, রন্ধনশিল্পী ও টেলিভিশনে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানের নামকরা উপস্থাপক। দ্য নর্দার্ন মাংকি ডট টিভি নামে তাঁর একটি নিজস্ব অনলাইন টেলিভিশন আছে। মা ক্লারা থাকেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে।
১১ জানুয়ারি রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে কথা হয় জেমি হেনশ্যালের সঙ্গে। চোখের কালো মণি তাঁর শরীরে বাঙালি রক্তের আভাস দিচ্ছিল। জানালেন, পিতার খোঁজে এক অনিশ্চিত অভিযাত্রায় নেমেছেন তিনি।
এত দিন পর কেন জানতে চাইলে জেমির কালো চোখের টলটলে পানি এবার উপচে পড়ল। চোখ মুছে বলতে শুরু করলেন, ‘গত বছর আমি বিয়ে করেছি, আমার স্ত্রী লরা হাক্সলে সন্তানসম্ভবা। মাসখানেক আগে স্ত্রী বলল, “তোমার সন্তানের পিতা তো তুমি, কিন্তু তোমার পিতা কে—এই কথা যদি তোমার সন্তান কোনোদিন জানতে চায়, তার জবাব কি তোমার কাছে আছে?”’ স্ত্রীর এই প্রশ্ন গভীরভাবে নাড়া দেয় জেমিকে।
বাবাকে খুঁজতে ৬ জানুয়ারি ঢাকায় এসেছিলেন জেমি। না পেয়ে গত ১৬ জানুয়ারি মন খারাপ করে নিজের কর্মস্থল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ফিরে গেছেন। মায়ের কাছ থেকে জেমি জেনেছেন, তাঁর দাদা উমাদ আলী পুরান ঢাকার কোনো এক চামড়ার কারখানায় (ট্যানারিতে) কাজ করতেন। জেমি বাংলাদেশ ট্যানারি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে গেছেন। সংগঠনটি থেকে তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়, তারা চেষ্টা করছে এই নামে কেউ আছেন কি না, তা খুঁজে বের করতে।
বাবাকে খুঁজে পেতে যাতে সুবিধা হয় সে জন্য জেমি উঠেছিলেন পুরান ঢাকার সদরঘাটের আহসান মঞ্জিল এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। পুরান ঢাকার বেশির ভাগ থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন এই নামে কারও কোনো রেকর্ড আছে কি না। জাতীয় পরিচয়পত্র, নিবন্ধন উইং থেকে শুরু করে বাবার সম্ভাব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়েও খুঁজে দেখেছেন, সত্তরের দশকে এই নামে এখানে কোনো শিক্ষার্থী ছিল কি না।
মায়ের কাছ থেকে জেমি জেনেছেন তাঁর বাবা সোয়াব আলী ১৯৭৪ সালে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার উদ্দেশে গিয়ে রন্ধনশিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণী হেনশ্যালের, এরপর প্রেম। ১৯৭৯ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। ১৯৮২ সালে জন্ম হয় জেমির। বাবা তাঁর নাম দেন মোহাম্মদ হোসেন আলী। তবে বংশপদবি দেওয়া হয় হেনশ্যাল। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে একটি কাজে যাচ্ছেন বলে যুক্তরাজ্য ছাড়েন তিনি। আর ফেরেননি।
জেমি বলেন, ‘জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার মাঝে বড় বেদনা বাবাকে না পাওয়া। তিন বছর বয়সে বাবাকে কেমন দেখেছিলাম, তা-ও মনে নেই। এখন আমি নিজে বাবা হতে চলেছি। তাই আমি আমার নিজের বাবা কী জিনিস, তা টের পাচ্ছি।’
গত ১৬ জানুয়ারি দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আবারও দেখা হয় জেমির সঙ্গে। পরিশ্রান্ত-ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। তবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘বাবাকে পাওয়ার কিছু সূত্র পেয়েছি। জুনে আবার আসব। বাবা যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবই।’ সুত্র প্রথম আলো