নতুন স্কেলে বেতন ‘বৈষম্য’ আরও বেড়েছে!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২১:০০,অপরাহ্ন ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ২৬২৫ বার পঠিত
বিশেষ প্রতিবেদন:: বেতন বৈষম্য কমাতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়ানো হয়েছে। এতে বৈষম্য আরও বেড়েছে।
নতুন স্কেলে বেতন পেতে নূন্যতম দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অথচ নিয়োগকালে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, সারাদেশের ৩ লাখ ৭৫ হাজার সহকারী শিক্ষকের অন্তত সোয়া লাখই নতুন স্কেলের সুবিধা পাবেন না। প্রাথমিক স্তরে মোট শিক্ষকের ৬০ শতাংশই নারী। সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হবেন তারা। এ ছাড়া এতদিন ১৪তম গ্রেডে চাকরি করলেও বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের বেতন ১৩তম পার হয়ে ১২তম গ্রেডে চলে গেছে। এখন ১৩তম গ্রেডে নতুন করে বেতন নির্ধারণ করতে গেলে এই শিক্ষকদের বেতন উল্টো কমে যাবে। এসব নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা অসন্তুষ্ট। শিক্ষক সংগঠনগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, শিগগির তারা নিজ নিজ সংগঠনের সভা করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
৯ ফেব্রুয়ারি সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে আদেশ জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেতন বাড়ানোর ফলে এই শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে (১১ হাজার টাকার) বেতন পাবেন। এতদিন তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ১৪তম গ্রেডে (১০ হাজার ২০০ টাকা) এবং প্রশিক্ষণবিহীনরা ১৫তম গ্রেডে (৯ হাজার ৭০০ টাকা) পেতেন। যদিও সহকারী শিক্ষকরা চেয়েছিলেন তাদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে (১২ হাজার ৫০০ টাকা) উন্নীত করা হোক। অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি।
একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় বেতন স্কেলে ১৩তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করায় ১০ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগবিধির ২(গ) ধারার শর্ত অনুসারে, নূ্যনতম স্নাতক দ্বিতীয় শ্রেণি ছাড়া এই গ্রেডে কেউ বেতন পাবেন না। যারা স্নাতক তৃতীয় শ্রেণি, কিন্তু স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় শ্রেণি- তারাও ১৩তম গ্রেড পাবেন না। একাধিক প্রধান শিক্ষক জানান, নতুন এ বেতন স্কেল নিয়ে একই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, নতুন স্কেল চালুর ফলে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু`জন প্রধান শিক্ষকের মধ্যে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ও জাতীয়কৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এইচএসসি পাস যোগ্যতা নিয়েও পাবেন ১১তম গ্রেডে বেতন। অথচ একই যোগ্যতা নিয়ে চলতি দায়িত্ব বা পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ১৩তম গ্রেডও পাবেন না।
শিক্ষকরা জানান, স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করার সময় চাকরি পাওয়া এবং পরে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও ১৩তম গ্রেড কেউ পাবেন না। একই সময়ে যোগ দেওয়া প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে চরম বেতন বৈষম্য বিরাজ করবে। কারণ ১১তম গ্রেডে যোগ দিয়ে চাকরির ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল হবে ৯ম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা। আর সহকারী শিক্ষক ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল হবে ১১তম গ্রেডে মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকা।
একাধিক শিক্ষক বলেন, ১৩তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ (ফিক্সেশন) উচ্চধাপে না নিম্নধাপে হবে তার কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। ফলে উন্নীত স্কেলের (বিএসআর-এর ৪২ ধারা অনুযায়ী) নিম্ন ধাপে ফিক্সেশন করলে গ্রেড বাড়লেও বাস্তবে সব শিক্ষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা বলেন, শিক্ষকদের দাবি অনুযায়ী বেতন বৈষম্য নিরসন না হওয়ায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
নতুন বেতন স্কেলের আদেশ জারির পর সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নিয়োগ বিধির ২(গ) ধারাতে বেতন নির্ধারণ নিয়ে শিক্ষকরা বেশি ক্ষুব্ধ। মূলত এই বিধির কারণে অনেক শিক্ষক ১৩তম গ্রেড থেকে বঞ্চিত হবেন। এই বিধিতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, `কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইতে দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের সিজিপিএসহ স্নাতক বা স্নাতক (সম্মান) বা সমমানের ডিগ্রি।` অথচ কর্মরত শিক্ষকদের বড় অংশই আগের নিয়োগবিধি অনুসারে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে আগের নিয়োগবিধিতে এইচএসসি পাস করে যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন, তারা বর্তমান নিয়োগবিধির আলোকে বেতন নির্ধারণ করলে ১৩তম গ্রেড থেকে বঞ্চিত হবেন। এ ছাড়া পুরুষ শিক্ষকদের মধ্যেও অনেক সিনিয়র শিক্ষক এই স্কেল থেকে বঞ্চিত হবেন। এমনকি চলতি দায়িত্বে থাকা ও পদোন্নতি পাওয়া প্রধান শিক্ষকরাও স্নাতক দ্বিতীয় শ্রেণি পাস করা না হলে ১৩তম গ্রেড পাবেন না।
শিক্ষকরা যা বলছেন: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৩তম গ্রেডে ঘোষণা আসার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকে সমকাল অফিসে ফোন করেও তাদের অসন্তুষ্টি ও দুঃখের কথা ব্যক্ত করেন।
রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিক রওশন আরা বীথি বলেন, শর্ত দিয়ে বেতন গ্রেড উন্নীত করায় প্রাথমিক শিক্ষকদের সমস্যা আরও প্রকট হলো; বিশাল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। প্রাথমিকে কর্মরত মোট শিক্ষকের তিন ভাগের দুই ভাগই তো শিক্ষাগত যোগ্যতায় উচ্চ মাধ্যমিক। তাদের মধ্যে তো অসন্তোষ তৈরি হবে। আবার ডিগ্রি পাস করলেও অনেক শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ গ্রহণ করা হয়নি। সনদ জমা দেওয়ার সুযোগ না দিলে শিক্ষকদের কী দোষ? তিনি বলেন, ১৩তম গ্রেড কেন, অনেক শিক্ষক তো ১২তম গ্রেডে এখন বেতন পান। তাদের কী হবে? বীথি বলেন, গ্রেড অনুযায়ী ইনক্রিমেন্ট দিলেও একটা কথা ছিল। তা তো হচ্ছে না।
নোয়াখালী সদর উপজেলার পানা মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাহেল আক্তার বলেন, স্নাতক (সম্মান) শেষবর্ষে পড়ার সময় তিনি চাকরি পেয়েছেন। যে কারণে তার সার্ভিসবুকে এখনও এইচএসসি পাসই লেখা আছে। যদিও তিনি পরে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তবুও ১৩তম গ্রেড থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ক্লাসে আমরা তো কম পড়াচ্ছি না।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ফানিসাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইলিয়াছ মিয়া বলেন, অনেক শিক্ষক ৩০-৩৫ বছর চাকরি করার পর চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেছেন। চাকরির শেষ বয়সে এসে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রির শর্ত জুড়ে দিয়ে উন্নীত বেতন স্কেল থেকে বঞ্চিত করা মানে আমাদের অপমান করা।
একই জেলার কচুয়া উপজেলার কোয়াকোট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ওমর খৈয়াম বাগদাদী রুমী বলেন, একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে এইচএসসি পাস প্রধান শিক্ষক পাবেন ১১তম গ্রেডে বেতন। আর এইচএসসি পাস সহকারী শিক্ষক এবং পদোন্নতি পাওয়া প্রধান শিক্ষকরা এখন ১৩তম গ্রেডও পাবেন না। এই বৈষম্য মেনে নেওয়ার মতো নয়।
সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার শিয়ালকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমিনুর ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলায় আমরা বেতন নির্ধারণে কোনো বৈষম্য মেনে নেব না। ১৩তম গ্রেড যদি শিক্ষকদের দিতেই হয়, সবাইকে দিতে হবে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার গোলকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সালেহা মুক্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নারীরা সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। এখন শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। যোগ্যতাভিত্তিক স্কেল দিতে হলেও তো অধিকাংশ শিক্ষক প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার বেতন গ্রেড দাবি করতে পারেন। তাছাড়া সরকারের অন্যান্য বিভাগে এইচএসসি পাস যোগ্যতায় ১১তম ও ১২তম গ্রেডেও বেতন দেওয়ার উদাহরণ আছে। এই প্রাথমিকেই আছে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লক্ষণখোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাবেরা বেগম বলেন, যারা নতুন আসবেন, নিয়োগবিধির কারণে তারা স্নাতক যোগ্যতা নিয়েই আসবেন। কিন্তু নিয়োগবিধির অজুহাতে পুরনো সিনিয়র শিক্ষকদের উন্নীত বেতন স্কেল থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। বিশেষ করে নারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য করা উচিত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব ও সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, যেখানে সহকারী শিক্ষকদের দাবি ১১তম গ্রেড, সেখানে ১৩তম গ্রেড দিয়ে নিয়োগবিধির অজুহাতে কাউকে বঞ্চিত করা শিক্ষকরা কখনও মেনে নেবেন না। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী যখন ১৪তম গ্রেডে বেতন উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন নিয়োগ যোগ্যতা এইচএসসি পাস থাকলেও এসএসসি পাস শিক্ষকরাও ওই গ্রেডের সুবিধা পেয়েছিলেন। তাহলে এখন কেন বেতনের জন্য নিয়োগবিধি অনুসরণ করতে হবে?
সরকারের ভাষ্য: প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড নির্ধারণে কারণ সরকার সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করতে চায়। সেটা হলে তাদের ১২তম গ্রেড দেওয়া হবে। আর প্রধান শিক্ষকরা পাবেন ১১তম গ্রেড। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের পদোন্নতির পদসোপান তৈরি হচ্ছে। তারা ধাপে ধাপে ওপরের পদে যাবেন। প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে নিতে হবে ভবিষ্যতে। সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতনের সামঞ্জস্য যেন থাকে, তা খেয়াল রাখা হবে।