আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই সরকারের এক বছর
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:২৬:৪০,অপরাহ্ন ০৭ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৩৬৮ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বছরপূর্তি আজ (৭ জানুয়ারী)। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়লাভ করে গত বছর এই দিনে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে দলটি। এই এক বছরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে বেশ কিছু সফলতা দেখিয়েছে সরকার। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি সরকারের বড় সাফল্য।
সরকারের বছরপূর্তি উপলক্ষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এ সরকারের মেয়াদে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা- এবং ভবিষ্যতে সরকারের পরিকল্পনা ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের বিস্তারিত তুলে ধরবেন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর আজকের এই দিনে মন্ত্রিসভার শপথের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
শুরুতে ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার আকার একজন বেড়ে বর্তমানে ৪৮। এর মধ্যে পূর্ণ মন্ত্রী ২৫, প্রতিমন্ত্রী ১৯ ও উপমন্ত্রী রয়েছেন ৩ জন। তাদের ৩১ জনই নতুন মুখ। মাঝে গত বছর ১৯ মে প্রথমবারের মতো স্বল্প পরিসরে মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কাউকে সংযুক্ত কিংবা বাদ দেননি তিনি। শুধু স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসানকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী পদে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার বিভাগ পুনর্বিন্যাস করা হয়। এরপর ১৩ জুলাই পদোন্নতি দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিকমন্ত্রী হিসেবে ইমরান আহমেদ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরাকে নতুন অন্তর্ভুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
টানা তিন মেয়াদে সরকার গঠন করে চমকের মন্ত্রিসভা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় বর্তমান সরকারের। নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে বছরের বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় স্থান পায় সরকারের অনেক ইস্যু।
বিশেষ করে ইতিবাচক সাড়া পড়ে ক্যাসিনো কান্ড, নিজস্ব স্যাটেলাইটে দেশের সব টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার ও পদ্মাসেতুর অগ্রগতিসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে।
একইভাবে শেয়ারবাজারের দুরবস্থা, খেলাপি ঋণ, ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর দফায় দফায় হামলা,আবরার ফাহাদ হত্যা, বিতর্কিত রাজাকার তালিকা, বালিশ ও পর্দাকান্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ইস্যুতে বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয় সরকারকে।
নতুন সরকার গঠনের পরপরই ঢাকার আশপাশে নদনদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নামে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। বছরব্যাপী এই অভিযানে কয়েকশ স্থায়ী স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় মন্ত্রণালয়। তবে বছরের শেষ দিকে এসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে চরম বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় সরকারকে। এই তালিকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর এবং রণাঙ্গনের অনেক আলোচিত মুক্তিযোদ্ধার নামও চলে আসে। ফলে সারা দেশেই ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে আসায় দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা। পরে এই তালিকা স্থগিত করা হয়।
টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো-জুয়াকা-ের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযান ছিল বেশ আলোচিত। এই অভিযানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের পদ হারাতে হয়। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়। বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আসে অনেকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বেশ প্রশংসিত হয়।
গত এক বছরে অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং চলমান প্রকল্পের অনেকগুলোর অগ্রগতিও ছিল দৃশ্যমান। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করে সরকার। গত বছর সব কটি টেলিভিশন চ্যানেল এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সম্প্রচার শুরু করে।
কয়েক বছর ধরেই রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বেশ জটিল সময় পার করছে। গত বছর এই সংকট থেকে উত্তরণে তেমন অগ্রগতি ঘটেনি। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আলোচনায় আসে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।
গত ১ নভেম্বর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করে। নতুন এই আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও সড়কের শৃঙ্খলার পরিপন্থী নানা অপরাধের শাস্তি ও জরিমানা কয়েকগুণ বাড়ানো হয়। সাধারণ মানুষ আইনটির প্রতি সমর্থন জানালেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। তাদের ধর্মঘটের মুখে সরকার আইনটি বাস্তবায়নে শিথিল অবস্থান নেয়।
গত বছর ক্রীড়াক্ষেত্রে এসএ গেমসে ১৯টি সোনা জিতে রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। তবে ক্রিকেট বিশ্বকাপে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। উল্টো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নিষিদ্ধ হওয়া এবং নানা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শীর্ষ ক্রিকেটারদের ধর্মঘট সারা বিশ্বে আলোচনার জন্ম দেয়। তবে মেয়েদের ক্রিকেট আশা দেখিয়েছে গেল বছর।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতারা পিটিয়ে মারলে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ ঘটনায় বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। বিব্রত অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও।
গত বছর শেয়ারবাজারে কোনো সুখবর ছিল না। সরকারের নানা আশ্বাসের পরও প্রায় বছরব্যাপী নেতিবাচক অবস্থায় ছিল শেয়ারবাজার, যা এখনো অব্যাহত আছে। তবে অর্থনীতির প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। বছরজুড়েই ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল বেশ আলোচনার বিষয়। সর্বশেষ গত রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, গত বছরে দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে। তাদের হিসাব মতে, গত বছর সারা দেশে ১ হাজার ৪১৫ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। আর ৩৮৮ জন মানুষ ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার’ হয়েছেন। গুমের অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও বছরজুড়ে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক ছিল’ বলে আসকের অভিমত।
গত বছরে ব্যাপক সমালোচিত ছিল রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশ কা-সহ বিভিন্ন প্রকল্পের লুটপাট ও দুর্নীতির বিষয়। তবে বছরের শেষ সময়ে এসে দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাও ছিল সরকারের জন্য সুখবর। আগামী ৩০ জানুয়ারি এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই এক বছরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে বেশ কিছু সফলতা দেখিয়েছে সরকার। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি সরকারের বড় সাফল্য। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী মেগা প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ প্রায় ডজনখানেক বড় প্রকল্প সময়মতো শেষ করার লক্ষেই দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে কাজ। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৭৬৭ মেগাওয়াট। যার মধ্য দিয়ে দেশের ৯৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত।
এছাড়াও ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম কর্মসূচির কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধার মাধ্যমে গ্রামের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের নিশ্চয়তা বাস্তবায়নের পথে। শিল্পায়ন, শিক্ষায় উন্নতি, সড়ক, রেলপথ ও বিমান পথে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নপূরণের পথে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ।
এ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠনের মধ্যদিয়ে নিরঙ্কুশভাবে জয় পায় এবং টানা তৃতীয়বারের মতো পাঁচ বছরের জন্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটসহ দেশের নিবন্ধিত সর্বমোট ৩৯টি দল অংশগ্রহণ করে।