শীতকাল পুণ্যবানদের বসন্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:১০:০৫,অপরাহ্ন ০৪ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৭৯০ বার পঠিত
।। মোঃ শামছুল আলম ।।
বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবার শীতকাল উপস্থিত। অন্যান্য মওসুমের মত শীতকালে প্রকৃতির মাঝে নানান পরিবর্তন দেখা যায়। শীতকালের একটি বিশেষ পরিবর্তন হল, রাত দিনের বাড়া কমা। শীতকালে রাত বড় হয়, দিন ছোট হয়। শীতকালে সময় ও আবহাওয়ার এ পরিবর্তনকে একজন মুমিন কীভাবে গ্রহণ করবে?
হাদীস শরীফে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, শীতকাল মুমিনের জন্যে বসন্ত। বসন্তকালে যেভাবে গাছগাছালি ও প্রকৃতি পত্রপল্লবে সমৃদ্ধ থাকে। পশুপাখি যত ইচ্ছা খেয়ে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে। ঠিক তেমনি মুমিন শীতকালের দীর্ঘ রাতকে ইবাদতে কাটিয়ে এবং দিনকে রোজায় কাটিয়ে লাভ করতে পারে প্রভুত আত্মিক উন্নতি।
শীত নবী (সা.) এর প্রিয় ঋতু। কেননা কনকনে শীতের রাতে তাহাজ্জুদের জন্য অজু করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। তিনি ফেরেশতাদের বলেন, ‘আমার এ বান্দার প্রতি লক্ষ করো। সে ইবাদতের জন্য নিজেকে কত কষ্টের সম্মুখীন করেছে। আমার কাছে এ বান্দা যা চাইবে, তা-ই পাবে।’ শীতকালকে ‘ইবাদতের বসন্তকাল’ বলা হয়। আবু সাইদ খুদরি (রা.) নবীজি (সা.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘শীতকাল মুমিনের বসন্ত।’ (মুসনাদে আহমদ)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর ভাষায়-‘শীত মুমিনের গনীমত।’ হজরত ওমর (রা.) -এর কথার সমর্থন পাওয়া যায় স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীতেও। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শীতের গনীমত হলো- দিনে রোজা রাখা।‘ –সুনানে তিরমিজি
অন্য বর্ণনায় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, শীতের রাতগুলো বড় হওয়ায় দীর্ঘ সময় নামাজে কাটানো যায়। আর দিন ছোট হওয়ায় বেশি বেশি নফল রোজা রাখা যায়।
ইমাম গাজালি (রহ.) লেখেন, ‘আল্লাহর মাহবুব (প্রিয়) বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কিনা আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোট থাকে আর রাতগুলো বড় হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয়।
প্রিয় নবী (সা.)-এর মতো সাহাবিরাও শীতকে ইবাদতের মৌসুম হিসেবে গ্রহণ করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তো রীতিমত শীতের গীত গাইতেন আর বলতেন, ‘হে প্রিয় ঋতু শীত! তোমাকে স্বাগতম।’ তিনি আরও বলতেন, ‘শীতে আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। কারণ এ সময় বেশি বেশি নফল নামাজ এবং নফল রোজা
পালন করা যায়।
শীতকালের প্রচন্ড ঠান্ডা আমাদেরকে জাহান্নামের শীতলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে কোন বান্দা যদি শীতকালে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে আল্লাহ তায়ালার কাছে পানাহ চায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামের শীতলতা থেকে মুক্তি দান করেন। এ ব্যাপারে হাদীস শরিফে এসেছে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যদি কোন বান্দা তীব্র ঠান্ডার সময় বলে- লা ইলাহা ইল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই)। আজকে দিনটি কতই না শীতল। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে জাহান্নামের জামহারীর থেকে মুক্তি দান করুন। তখন আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামকে লক্ষ্য করে বলেন, আমার এক বান্দা তোমার জামহারীর থেকে আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। আমি তোমাকে সাক্ষ্য রেখে বলছি, আমি তাকে মুক্তি দিলাম। সাহাবীগণ বললেন, জামহারীরকি? উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন- জামহারীর হলো এমন একটি ঘর, যেখানে কাফেরদেরকে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে এর ঠান্ডার প্রচন্ডতায় তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।
অতএব আমাদের কর্তব্য হলো, প্রচন্ড ঠান্ডার দিনে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট জাহান্নামের জামহারীর থেকে মুক্তি চাওয়ার মাধ্যমে পরকালীন শান্তির পথ সুগম করা।
এ ছাড়া এই শীতকালে আমরা আরো অনেক রকমের নেক আমল করতে পারি। যেমন—
অসহায় দরিদ্রদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। এই যে আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ আছে, যারা ঠিকমতো দুই বেলা খেতে পায় না, এই হাড় কাঁপানো শীতেও যাদের একটি গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই, আমরা কিন্তু ইচ্ছা করলেই এই অসহায় মানুষদের কষ্ট লাঘব করতে পারি। আমাদের অনেকেরই তো তিন-চারটি করে শীতের পোশাক রয়েছে। আমরা যদি সেখান থেকে একটি পোশাক তাদের দান করি, তাহলে তারা যতটা না খুশি হবে, দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তার চেয়ে বহু গুণ খুশি হবেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মানব সেবাই পরম ধর্ম। আর এ কথাই ইসলামের প্রাণপুরুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই বিশ্বলোকে ছড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (মুসলিম-২৩১৯)
তাই আসুন, শীতের এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাই। শীতের এই দীর্ঘ রজনীকে ঘুমের রাজ্যেই বিলীন না করে দিই।
গভীর রজনীতে প্রকৃতি যখন বিভোর থাকবে ঘুমের অরণ্যে, যখন ডেকে উঠবে না কোনো নিশাচর, নড়বে না বৃক্ষপল্লব, তখন জেগে ওঠি প্রভুর সান্নিধ্যে। এই অস্থায়ী সুখকে তুচ্ছজ্ঞান করে পরকালীন চিরস্থায়ী সুখের প্রত্যাশায় আল্লাহর অদৃশ্য পায়ের সামনে দাঁড়াই অবনত মস্তকে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও সাবেক অফিসার, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিঃ।