তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ..
প্রকাশিত হয়েছে : ১:০৬:৩৫,অপরাহ্ন ০১ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৭৭০ বার পঠিত
:ইনাম আহমদ চৌধুরী:
গত সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ আকস্মিকভাবেই এক ব্যক্তিগত চিঠি পেলাম। প্রেরক স্যার ফজলে হাসান আবেদ। কেসিএমজি। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ার ইমেরিটাস। চিঠিটির বাংলা তর্জমা নিম্নরূপ :
“প্রিয় ইনাম,
সম্প্রতি লন্ডনে আমার রোগ নির্ণয় হয়েছে গ্লায়োব্লাস্টোমা, ব্রেনের একটি ম্যালিগনেন্ট টিউমার। এর জন্য আমার আয়ুস্কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আর কয়েক মাস মাত্র। আমি স্থির করেছি, কোনো সার্জারি করাব না। করালে হয়তো আমার জীবনকালের যৎসামান্য তারতম্য হবে; কিন্তু তা আমার বাঁচার যে অল্প কিছু দিন আছে, তার স্বাভাবিকত্ব অনভিপ্রেতভাবেই পাল্টাবে।
আমি এখন ‘ব্র্যাক গ্লোবাল’ সংগঠিত করছি, যাতে করে ‘ব্র্যাকে’র বিভিন্ন অংশকে সুসংহত রেখে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ক্ষমতায়নের চলমান কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। আমার শারীরিক অবস্থার খবরটি তোমার নিজের মধ্যেই সীমিত রাখলে কৃতজ্ঞ থাকব।
ওয়ার্মেস্ট রিগার্ডস- আবেদ।”
চিঠিটা ছিল আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ব্যক্ত অনুরাধ এবং পরবর্তী ফোনালাপের পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করিনি। দুই-তিন মাস আগেই জেনেছিলাম যে, তাঁর শরীর ভালো নেই। ক্যান্সার শনাক্ত হলেও তো আজকাল রোগী বুঝে আধুনিক চিকিৎসার কল্যাণে কখনও-বা বেশ কিছুকাল বেঁচে থাকে। এ চিঠিটি সব আশা চূর্ণ করে দিল। তবে দেখলাম, অন্তিম মুহূর্তেও ব্র্যাকের চিন্তাভাবনাই তার মনজুড়ে।
আবেদ আমার ছাত্র জীবনের বন্ধু। স্কুলজীবনে ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আর ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার প্রায় প্রথম দিন থেকেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সূচনা। ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (১৯৫২-৫৩) জেনারেল সেক্রেটারির পদে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আমি জিতেছিলাম। সেখানে পেয়েছিলাম তার সক্রিয় সমর্থন। তবে তিনি রাজনীতি পরিহার করতেন। এমনকি ছাত্র রাজনীতিও বিষবৎ পরিত্যাজ্য। কিন্তু তিনি ছিলেন সমাজসচেতন এবং নীতিনিষ্ঠ। মনে আছে, ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম ও শহীদ মিনার নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে আমার এবং আরও কয়েকজনের বহিস্কারাদেশের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, তাতে ছিল তার বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ। তিনি বলেছিলেন, আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
তখনও লক্ষ্য করতাম, তিনি ছিলেন নতুনত্বের সন্ধানী। আইএসসি পাসের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি (এবং আরও দুই বন্ধু) চলে গেলেন গ্লাসগোতে নেভাল আর্কিটেকচার পড়তে। কিন্তু সেখানে কিছু দিন পড়াশোনার পর তার মনে হলো, এখানে অর্জিত জ্ঞান এ দেশের মানুষের কোনো কাজে লাগাতে পারবে না। শুনলে অবাক লাগে, কিন্তু এটাই তার অধ্যয়নের বিষয় পরিবর্তনের কারণ। আর এ জন্যই লন্ডনেও ‘কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্সি ও ম্যানেজমেন্ট’ পড়ল। তারপর আন্তর্জাতিক শেল কোম্পানিতে ভালো চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম চলে এলেন। ‘৭০-এর সাইক্লোন এবং ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের উদ্দেশ্য ও ধারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিল। শেল-এর লোভনীয় চাকরি ছেড়ে তিনি লন্ডনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ ও সমর্থন আদায়ের জন্য কয়েকজন সমমনাকে নিয়ে গঠন করলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’। যুদ্ধান্তে ফিরে এলেন বাংলাদেশে। ‘৭২-এর শুরুতেই সদ্য স্বাধীন দেশ ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য তিনি বেসরকারি উদ্যোগের সূচনা করলেন। তার পরই কর্মপরিধি বাড়িয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের বিভিন্নমুখী উন্নয়নের জন্য গড়ে তুললেন ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’ বা সংক্ষেপে ব্র্যাক। কার্যারম্ভের জন্য বেছে নিলেন সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুটি থানা- দিরাই ও শাল্লা। ওটাই হলো তার নতুন ও চিরকালের ঠিকানা।
‘৭২-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের ধানমন্ডির পৈতৃক নিবাস সুরমাতে তিনি একাধিক আলোচনা সভা করেন। তখন তার সহকর্মী হিসেবে ছিলেন (প্রয়াত) ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী ও (প্রয়াত) চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সৈয়দ ফজলে আলী। প্রয়াত ফারুক চৌধুরী (আমার বড় ভাই) তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিফ অব প্রটোকল এবং একজন প্রধান কর্মকর্তা। তিনিও ছিলেন আবেদের সুহৃদ বন্ধু এবং পরবর্তীকালে সহকারী। বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগে তিনি সহায়তা করতেন। আমি ছিলাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। সব ‘এসেনশিয়াল সাপ্লাই’ তখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে। ব্র্যাকের কার্যক্রম সরবরাহে সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল, যা আমার পক্ষে করা সহজসাধ্য ছিল। আমার ভগ্নিপতি লে. কর্নেল এসএ হাই ‘৭১-এর ৩০ মার্চ শহীদ হয়েছিলেন। বোন শহীদজায়া নাসিম যোগ দিলেন ব্র্যাকের সূচনার এই প্রথম লগ্নে। ওখানে ছিলেন বছর দুই। প্রথমে চার-পাঁচজন নিয়েই ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হলো। আর আজ? লাখ লাখ কর্মী ও অংশগ্রহণকারী নিয়ে বিশ্বের ১২টি দেশের কোটি কোটি মানুষের বিভিন্নমুখী সেবায় নিয়োজিত ব্র্যাক পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ এনজিও। এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, এটা সম্ভব হয়েছিল একজন মানুষের বিরাট স্বপ্ন, মহান কল্পনা, অবিচল আদর্শ, নিষ্ঠা ও কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। তারই কল্যাণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ শুধু একটি দানগ্রহীতা দেশ থেকে সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ হিসেবে ভূমিকা পালন করার সুযোগ পেল।
আমার কাছে মনে হয় ‘ক্ষণজন্মা’ শব্দটির যথার্থ প্রয়োগ ফজলে হাসান আবেদের বেলায় সত্যিই খাঁটি। তার মহাপ্রয়াণে বিশ্বের একটি অন্যতম উজ্জ্বল বাতি নিভে গেল। কিন্তু তার আলোকের রেশ থেকে যাবে। আবেদের বিরাট আরেকটি কৃতিত্ব ব্র্যাকের কর্মধারা ও চিন্তাপ্রবাহ অব্যাহত রাখার সুব্যবস্থা তিনি করে যেতে পেরেছেন। সেই কৈশোর থেকে, জীবনের দীর্ঘ পথচলায় তাকে যতই দেখেছি, পশ্চাৎ চিন্তায় আজ মনে হয়, ততই তার গুণাবলি উন্মোচিত হয়েছে- সপ্রশংস বিবেচনায় তাকে নতুন মহানরূপে অবলোকন করেছি।
সেই কলেজ জীবনে তার অনুসৃত অরাজনৈতিক অবস্থানে থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার হতে দ্বিধা করেননি। দেশের মানুষের কাজে আসতে পারবে না জেনে স্কলারশিপে অনুসৃত অধ্যয়নের বিষয় ছেড়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও নতুন একটি বিষয় নিয়ে সংগ্রামী জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এসে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সুবিধা আদায়ের চেষ্টা না করে আর্তমানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে আত্মনিয়োগ করা- এর চেয়ে ব্যতিক্রমী আর কী হতে পারে? সত্তরের দশকে যখন মধ্যবিত্ত বাঙালি প্রায়ই বিদেশ যেতে আগ্রহী ছিল সুখী নিরাপদ জীবনের অন্বেষায়, তখন আবেদ এলেন সমস্যা-আকীর্ণ বাংলাদেশের হতদরিদ্র দুস্থ মানুষের কাছে আশার বাণী ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে। সম্ভবত ১৫ হাজার পাউন্ডে লন্ডনের নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে জোগালেন ব্র্যাকের ‘সিড মানি’; গৃহহীনের জন্য আবাস নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নে যা ব্যয়িত হলো।
ব্র্যাকের সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বা সম্পর্ক আমার ছিল না। তবুও বন্ধুত্বের নৈকট্যে এবং পারিবারিক সংশ্নিষ্টতায় তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে আলোচনা হতো প্রায়ই উন্নয়ন-সংক্রান্ত বিষয়ে। জীবিকার অন্বেষণে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমারও বিচরণ ক্ষেত্র ছিল মুখ্যত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। সব আলোচনায়ই লক্ষ্য করতাম, আবেদ ব্র্যাক ধ্যান-ধারণা থেকে মোটেই বিচ্যুত হতেন না। সবসময়ই তার ভাবনায় থাকত- আরও ভালো কী করে করা যায়? আর নতুন কী উপায় আছে মানুষকে দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসার?
উন্নয়ন বলতে আবেদ বোঝাতেন সামগ্রিক উন্নয়ন। এখানে রয়েছে অর্থ উপার্জন, খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষার প্রসার, বাসস্থানের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা, নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজ সচেতনতা, মুক্ত চিন্তা। অর্থাৎ একটা সমাজের ভালোভাবে বেঁচে থাকার সবক’টি উপকরণ। একদম হতদরিদ্রের প্রয়োজন প্রথমেই জীবন সংস্থান। সেখানে তার প্রয়োজন ক্ষুদ্রঋণ। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি অর্জনের জন্যই অন্য সবকিছুরই প্রয়োজন। তা ছাড়া সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষ রয়েছে, তাদের প্রয়োজন ভিন্ন। তাই ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা সম্পন্ন ও মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীদের কথা মনে করে গড়ে তুললেন ব্র্যাক ব্যাংক। অর্থনৈতিক লেনদেনে বিকাশ। বাসস্থানের জন্য ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাধর্মী কার্যক্রমের জন্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। কুটির শিল্প ও তাকে ভিত্তি করে দেশি ও গ্রামীণ শিল্পকলার বিকাশে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রয়োজন পূরণে আড়ং। তা ছাড়া ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক নার্সারি, ব্র্যাক প্রিন্টিং, ব্র্যাক স্যানিটারি নেপকিন ও ডেলিভারি কিট, ব্র্যাক সিড- আরও কত কি! আনন্দঘন পরিবেশে অনানুষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা, ব্র্যাক স্কুল- তা পৃথিবীর শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এক অনন্যসাধারণ সংযোজন। আবেদের অধিকাংশ উদ্যোগে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এবং নারীর ক্ষমতায়নে অত্যন্ত বলিষ্ঠ উপস্থিতি, বিশেষ করে সমাজে নারী-পুরুষের ক্ষমতা অর্জন, নারী শিক্ষা ও নারীকে যথোপযুক্ত মর্যাদাদানকে সার্বিক উন্নয়নের চাবি হিসেবেই গণ্য করতেন। এমনকি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অসহায়দের আইনি সহায়তা প্রদান, কমিউনিটি ক্ষমতায়ন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় যথোপযুক্ত প্রস্তুতি, দক্ষতা উন্নয়ন, পানি ও পয়ঃনিস্কাশন- সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ব্র্যাকের উদ্ভাবনী কার্যক্রম এবং ফলপ্রসূ পদচারণা।
এত বিরাট ও মহান ছিল তার চিন্তা-ধারণা, কার্যক্রম। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে আবেদ ছিলেন সম্পূর্ণ নিরহঙ্কার, নির্মোহ, অতীব বিনয়ী, সজ্জন ও একজন সামাজিক ব্যক্তি। বহু বিদেশি রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশে তাদের অভিজ্ঞতার সুন্দরতম এবং মহত্তম অংশ হচ্ছে ব্র্যাকের কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের পরিচিতি। আশ্চর্য, সব ক্ষেত্রেই যেন আবেদ ছিলেন অদ্বিতীয়; এমনকি সামাজিকতায়ও। প্রত্যেক বসন্তে ব্র্যাকের সাভার কেন্দ্রে বা কোনো উপযুক্ত স্থানে তিনি অনুষ্ঠান করতেন দিনব্যাপী এক সামাজিক মিলন মেলার। দেশি-বিদেশি ব্র্যাকের শুভার্থীরা জড়ো হতেন আপ্যায়নের মাধ্যমে এক আনন্দঘন পরিবেশে। তা হচ্ছে ব্র্যাকের প্রতি সবার সপ্রশংস অনুরক্তি। আলোচনা, সমালোচনাও হতো। আবেদ চিন্তা করতেন, উদ্ভাবন করতেন; কিন্তু যথাসম্ভব আলোচনা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। আশা করি, ব্র্যাকের এই বার্ষিক অনুষ্ঠান চালু থাকবে- যেমন চালু থাকবে ব্র্যাকের শতমুখী কর্মকাণ্ড।
প্রয়াত ফারুক চৌধুরী, যিনি সুহৃদ হওয়া ছাড়াও দীর্ঘকাল ব্র্যাকের সক্রিয় উপদেষ্টা এবং এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ব্র্যাক বিষয়ক রচিত বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন- আবেদের নেতৃত্বই ব্র্যাকের সামগ্রিক সাফল্যগাথার মর্মকথা। এর অঙ্কুর থেকে মহিরুহ হয়ে ওঠার যে চমকপ্রদ উপাখ্যান, সেখানে তার ভূমিকা এক ও অদ্বিতীয়।
আবেদ যেসব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন- আমার মনে হয় না পৃথিবীতে এত বেশি, এত ব্যাপক এবং এত উঁচু মানের প্রাপ্তি কেউ জীবদ্দশায় পেয়েছেন। বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে তিনি পেয়েছেন র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড, স্বাধীনতা পুরস্কার, দারিদ্র্য বিমোচনে অসামান্য অবদানের জন্য যুক্তরাজ্য থেকে নাইটহুড, শিক্ষায় অবদানের জন্য উচ্চতম ইদান পুরস্কার ও স্বর্ণপদক, নেদারল্যান্ডস থেকে তাদের সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মান নাইটহুড, লিও টলস্টয় পুরস্কার, ওয়াইজ প্রাইজ অব এডুকেশন, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পুরস্কার সিঙ্গাপুর থেকে। এবার অর্থনীতিতে যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তার মধ্যে অভিজিৎ ব্যানার্জির নোবেল পুরস্কৃত থিসিস ব্র্যাকের প্রজেক্টের ওপরই গবেষণাভিত্তিক ছিল।
আমি তাকে একাধিকবার বলেছিলাম- দেখা হলেই তোমাকে আমি অভিনন্দন জানাই এ জন্য যে, তোমার প্রাপ্তির ‘ট্র্যাক’ রাখা দুস্কর। হরহামেশাই তো পাচ্ছ। তিনি হেসে বলেছিলেন- ‘এর মানে আমাদের উন্নয়ন ঘটছে। এ অভিনন্দন সবারই প্রাপ্য।’
আবেদ সবসময়ই বলতেন, মানুষ যে তার আপন চেষ্টায় তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে, সে উপলব্ধি অনেকেরই নেই। যখনই তা সে বুঝতে পারে, তখনই একটি বাতি প্রজ্জ্বলিত হলো। আবেদের প্রয়াণে দেশি-বিদেশি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন, তা অভূতপূর্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হাসান আবেদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা এবং নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তার ভূমিকার কথা স্মরণ করে বলেছেন- এমন একজন মহান মানবতাবাদীর প্রস্থান জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বলেছেন- ‘স্যার ফজলের জীবন ছিল মানবতার জন্য এক মহান আশীর্বাদ। এই স্বপ্নদ্রষ্টার ৫০ বছরের নেতৃত্ব বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের লাখো কোটি মানুষের জীবন পাল্টে দিয়েছে। উন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণাকে তিনি করেছেন পরিবর্তিত।’ বিল ও মেলিন্ডা গেটস বলেছেন- ‘আমরা ও সারাবিশ্ব তার কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা পাই।’ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন- আবেদকে বিদায় জানানো সম্ভব নয়। সে তো আমাদের চিরসাথি হয়ে থাকবে। সে যে বাংলাদেশ বানিয়ে দিয়ে গেছে, তার বুনিয়াদের ওপর ভর করে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব নেওয়া পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ হলো।
ফজলে হাসান আবেদ সংগীতপ্রেমী ছিলেন। তার প্রিয়তম গান ছিল- ‘তুমি রবে নীরবে’ এবং তার প্রিয়তম কবিতা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘শা-জাহান’। এত সামাজিকতার মাঝেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ। ঢাকঢোল না পিটিয়ে আপন উদ্দিষ্ট সাধনে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। শা-জাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি রক্ষার্থে এমন একটি কালজয়ী সৌধ নির্মাণ করেছিলেন, যা ছিল ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/এ তাজমহল’। সম্রাট জানতেন, ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন ধন মান।’ তাই তিনি তার ‘অন্তর বেদনা’কে চিরস্থায়ী করার মানসে এমন একটি কীর্তি তৈরি করলেন, যা ‘তুচ্ছ করি রাজ্য-ভাঙাগড়া, তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া’, যুগ যুগান্তরে কালজয়ী হয়ে বেঁচে থাকবে। মানুষের প্রতি আবেদের ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধ এবং মানব জীবনের মানোন্নয়নে তার দৃঢ়চেতা সংকল্পের বাস্তবায়নের সার্থক প্রচেষ্টাকে তিনি একটি চিরস্থায়ী কাঠামোতে সংরক্ষিত করে গেলেন, যার কার্যক্রম থাকবে অব্যাহত। আর সেটাই হলো ব্র্যাক। আবেদের জীবনে তার প্রিয় শাজাহানের স্বপ্নের প্রতিফলন, স্বপ্নদ্রষ্টা আবেদের নিজস্ব রূপকল্পে ইন্তেকালের আগেই তিনি আলাপ-আলোচনা ও বিবেচনা করে তার উত্তরসূরি নির্ধারণ করে গেছেন। ব্র্যাক তাই আজ আর থমকে দাঁড়াবে না। ব্র্যাকের অগণিত কর্মী তাই এক বাক্যে বলেছেন, বলতে পেরেছেন- ৪৭ বছর ধরে দারিদ্র্য আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবিরাম যে লড়াই আপনি চালিয়ে গেছেন, তা এখন আমাদের এগিয়ে নেওয়ার পালা। আমাদের বুকে আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়েছেন আপনি। মানুষের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে চিনতে শিখেছি আমরা। সমতাপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধে। ব্র্যাকই আবেদের তাজমহল।
আবেদের তিরোধানে শোকাহত হয়েছেন দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষ। ঢাকায় তার জানাজায় নেমেছিল মানুষের ঢল। দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের, সব মতাদর্শের নেতাকর্মী, সব শ্রেণির মানুষের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধাঞ্জলি তিনি পেয়েছেন। অভূতপূর্ব ছিল এই সমাবেশ।
বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়- মানব উন্ননের জন্য অপরিহার্য যেসব ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন- শিক্ষা, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, আর্থিক সঙ্গতি অর্জন, কমিউনিটি ক্ষমতায়ন- সব বিষয়েই তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা। বিচিত্র ও ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় এ ধরনের বিরাট সাফল্য কেউ পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তার সৃষ্ট প্রজেক্ট বা কর্মসূচির সমাপ্তি হতে পারে; তবে এটা সত্যি যে, তার সার্থক কর্ম প্রচেষ্টার বাণী ধ্বনিত হতে থাকবে। আর তার মাধ্যমেই আবেদ বেঁচে থাকবেন চিরকাল বঞ্চিত সংগ্রামী মানুষের, নির্যাতিত নারীর, উন্নয়নপ্রত্যাশী জনগণের চিরসাথি হয়ে।
লেখক: সাবেক সচিব ও ফজলে হাসান আবেদের বাল্যবন্ধু