অতীত আর কখনোই ফিরে আসবে না
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৩১:০২,অপরাহ্ন ০১ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৭৮২ বার পঠিত
::বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল::
আজকাল আমাকে নানা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় ভর করে। এই যেমন, কয়েকদিন ধরে কেবলই মনে হচ্ছে – ‘ভালো আছি’ কথাটা চিরকালের জন্যে পাস্ট টেন্সের অধিকারে চলে গেছে; প্রতিটি মধুর ঘটনাই যেমন যায়! নিশ্চয়ই ভাবছেন – শুধু মধুর ঘটনাই কেন অতীত হতে যাবে? অতীত তো হয়ে যায় সব ঘটনাই – আজকের বর্তমান, আগামীকাল হয়ে যাবে অতীত, এমনকি এই মুহূর্তের বর্তমান একটু পরই চলে যাবে অতীত কালের দখলে! হ্যাঁ, আপনাদের মতো আমিও সেটা জানি – এই ধরনের চিন্তার প্যাটার্নের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু কিছু সত্য যেন কখনো-কখনো সবার চোখের আড়ালে থাকে, যেগুলো নিয়ে সম্ভবত খুব বেশি ভাবি না আমরা। অন্তত আমার সেরকমই মনে হচ্ছে আজকাল! মনে হচ্ছে – সব ঘটনাই অতীত-কালের সম্পত্তি হয়ে যায় না, কিছু ঘটনা চিরকাল ধরে ঘটমান থাকে। সে-সব ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো অতীত থাকে না, ভবিষ্যতও থাকে না – ‘কাল’ হয়ে ওঠে মাত্র একটি, সেটি বর্তমান কাল – তা-ও ‘ঘটমান বর্তমান।’ মানে ঘটেই চলেছে, বিরামহীনভাবে। এই যেমন, আমাদের জীবনের নানাবিধ দুর্ভোগ। একটা কাটিয়ে উঠতে-না-উঠতে আরেকটা। ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, পেশাগত জীবনে, সামাজিক জীবনে, জাতীয় জীবনে কেবলই দুর্ভোগ আর দুর্ভোগ। একটার পর একটা। স্বস্তি নেই এতটুকু, কোথাও। এগুলোর যেন কোনো অতীত-ভবিষ্যৎ নেই, আছে শুধু বর্তমান। একবারে সুনির্দিষ্ট উদাহরণ চান? না, আমার পক্ষ থেকে উদাহরণ না দিলেও চলবে। একটু চোখ ও মন খুলে আপনার চারপাশে একটু তাকান, দেখবেন – কিছু মানুষ সারাজীবন ধরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মার খেয়ে যাচ্ছে। তাদের জীবনকে বলা যায় – মার খাওয়া জীবন! গ্লানি-দুঃখ-বেদনা-অপমান ইত্যাদিই হচ্ছে তাদের একমাত্র-অনিবার্য প্রাপ্য – তাদের যেন আর কোনো প্রাপ্তি নেই! তাদের জীবনে এই মার খাওয়ার ব্যাপারটা কখনো অতীত হয়ে যায় না! আরো উদাহরণ? তাহলে বলি – দেখবেন, কিছু মানুষ কেবলই ভোগান্তির শিকার হয়ে চলেছে। কোনো কাজই তারা সহজ-সুন্দরভাবে শেষ করতে পারছে না। হাজার-হাজার বাধা আসছে, সেই পাহাড়সম বাধা পেরোতেও পারছে না তারা। ফলে সব কাজে অনিবার্য ব্যর্থতাই তাদের নিয়তি। এই ধরনের মানুষদের জন্য ব্যর্থতা ব্যাপারটা চিরকাল ঘটমান-বর্তমান, কখনোই অতীত নয়! আর এই সবকিছু দেখে আজকাল আমার এই ধারণা হতে শুরু করেছে – অতীত কালটা খুব চুজি, বর্তমানের সব ঘটনাকে সে নিজের অঞ্চলে প্রবেশাধিকার দেয় না; দেয় শুধু মধুর-সুন্দর-কাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোকে। আর অতীত-অঞ্চলে প্রবেশের ফলে এই মধুর ঘটনাগুলো তখন হয়ে ওঠে স্মৃতির অংশ, হয়ে ওঠে আরো মধুর, আরো কাঙ্ক্ষিত। এবং বেদনারও – যেহেতু এগুলোকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, সেই অর্থে! ( যেমন, এই ‘ভালো আছি’ শব্দবন্ধটি। যেন স্মৃতির অংশই ওটা। আর তাই, যথার্থ কারণেই ,মধুর ও কাঙ্ক্ষিত। একই সঙ্গে বেদনারও – ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না বলে!) বর্তমানের যে ঘটনাগুলোকে নিজের দখলে নিতে অস্বীকার করে অতীত, বা প্রত্যাখান করে প্রবেশাধিকার, সেগুলো বর্তমানেই থেকে যায়! অতীতে যেতে পারে না বলে সেগুলো চির-বর্তমান। ঘটমান-বর্তমান। যেমন… যেমন. কতোগুলো বলবো? বলে তো শেষ করা যাবে না। মন চাইলে আপনারাও বলতে পারেন, প্রিয় পাঠক।একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে খুব, এই প্রসঙ্গে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দ ভৈরবী –
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ ভৈরবী
…
রবার্ট লুই স্টিভেনসন বলেছেন— ‘প্রতিটি ব্যক্তিই তার দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম, সে কাজগুলো যতই কঠিন হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। প্রতিটি লোকই সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত তার সারাটা দিন সুখে কাটাতে সক্ষম, আর সেটাই জীবনের অর্থ।’
স্টিফেন লীকক বলেছেন— ‘শিশু বলে, আমি যখন বালক হব… বালক বলে, আমি যখন তরুণ হব… আর যখন সে সময় এসে যায় তখন সে বলে, আমি যখন বিয়ে করব…। বিয়ের পরে কী ঘটে? আর এসব পর্যায় পার হওয়ার পর কী হয়?
সবাই একটি চিন্তার পিছনে সদাই পড়ে আছে যে, যখন আমি অবসর হতে পারব…। কিন্তু, সে যখন সত্যিই বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে তখন পেছন ফিরে তাকায়, অর্থাৎ অতীতের বিষয় নিয়ে চিন্তা করে দেখে, আর একটা হিম-শীতল বায়ু প্রবাহে শিহরিত হয়, অর্থাৎ অতীতের দুঃখময় ঘটনার কথা ভেবে বিষাদে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। সে ভাবে যে, সে তার সারা জীবন বৃথা নষ্ট করেছে, এক মুহূৰ্তও (সুখে) কাটাতে পারেনি। আর আমরা এভাবেই অনেক পরে বা দেরিতে শিখতে পারি যে, বর্তমান কালের প্রতিটি মুহূর্ত জীবনকে উপভোগ করা বা বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোই (প্রকৃত সুখের) জীবন।’
যারা তওবা করতে বিলম্ব করে— এই হলো তাদের অবস্থা।
আমাদের একজন ধাৰ্মিক পূর্বসূরী বলেছেন— ‘বিলম্ব করার ব্যাপারে এবং ‘আমি পরে করবো’— একথা বলার ব্যাপারে আমি তোমাকে সতর্ক করছি কারণ, এটা এমন কথা যা মানুষকে ভালো কাজ করা থেকে বিরত রাখে এবং সওয়াবের কাজ করা থেকে পিছনে ফেলে দেয়।’
‘তাদেরকে খাওয়া-দাওয়া ও ফুর্তি করতে দাও এবং মিথ্যা আশায় তারা মোহাচ্ছন্ন থাকুক। কেননা, শীঘ্রই তারা (প্রকৃত ঘটনা) জানতে পারবে।’ [সূরা হিজর: ৩]
ফরাসী দার্শনিক মন্টেইন বলেছেন— ‘আমার জীবনটা দুর্ভাগ্যে ভরা ছিল, (ও আমার জীবন,) আমাকে কখনো করুণা দেখাওনি।’
আমি একথা স্বীকার করছি যে, তাদের জ্ঞান ও মেধা থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রসিদ্ধ অনেকেই তাদের সৃষ্টির আড়ালে যে রহস্য রয়েছে তার কিছুই জানত না। আল্লাহ তার রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে শিক্ষা পাঠিয়েছেন তারা সে শিক্ষা দ্বারা পরিচালিত হতেন না।
‘আর যার জন্য আল্লাহ আলোর ব্যবস্থা করেননি, তার জন্য কোনো আলো নেই।’ [সূরা আন-নূর: ৪০)
‘আমি অবশ্যই তাকে পথ দেখিয়েছি, এবার চাই সে কৃতজ্ঞ হোক, নয় তো হোক অকৃতজ্ঞ।’ [সূরা দাহর: ৩]
ডেন্টি বলেছেন— ‘একথা ভাবুন যে, আজকের এই দিনটি আর কখনো ফিরে আসবে না।’
এর চেয়ে উত্তম, সুন্দরতর ও অধিকতর পূর্ণ অর্থ বহনকারী হলো এই হাদীসটি— ‘এমনভাবে সালাত (নামাজ) আদায় করো যেন এটা তোমার বিদায়কালীন সালাত।’
যে ব্যক্তি এ কথা মনে রাখে যে, আজকের দিনটিই তার শেষ দিন সে খাঁটি তওবা করবে, আমলে সালেহ বা নেক আমল করবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনুগত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।দুনিয়া যে লক্ষ্য হিসেবে খুব দুর্বল এবং লজ্জাজনক তা এই ক্ষণস্থায়ী হওয়ার ব্যাপারটা থেকেই বোঝা যায়। আল্লাহর কাছে যখন ফিরে যাবো আমরা, তখন এই দুনিয়ার কাজের প্রতিফল হিসেবে পাবো উত্তম ও অনন্তকালের পুরষ্কার ও শাস্তি।ছোট ছোট কাজ তো দূরে থাক, বড় কাজ করেও দুনিয়াতে লোকের স্মৃতিতে থাকা যায় না, কিন্তু মহান আল্লাহর কাছে ছোট কাজ করেও প্রিয় হয়ে অনন্ত জগতের সফলদের দলে যাওয়া যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সত্যিকারের সফলতা অর্জনের তাওফিক দান করুন।