বিপ্লব ও বিপ্লবী নেতা এবং মজলিস নেতার প্রশ্নবিদ্ধ বিপ্লবী চিন্তা…
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৩৩:৩৪,অপরাহ্ন ০১ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ১৩৩৯ বার পঠিত
::ইকবাল হাসান জাহিদ::
বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের চিন্তা ও চেতনার ব্যাপারে এই সময়ের নতুন বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সামান্যতম হলেও আইডিয়া থাকা উচিত। শুধু আইডিয়া বা জ্ঞান থাকাই দরকারি নয় বরং বিপ্লবীদের আদর্শ, কর্ম ও চিন্তার সকল ক্ষেত্রকে নিজের বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে উপলব্দি করতে হবে।
এ ব্যাপারে আমি প্রথমে গত শতাব্দির কিছু বিপ্লবী ব্যক্তিত্বের নাম বলতে চাই। যারা বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি অর্জন করে বিপ্লবী চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রে। প্রথমেই বলব বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ আধুনিক মিসরের স্বপ্নদ্রষ্টা সাইয়েদ কুতুব শহীদের কথা। বিপ্লবী চিন্তাধারায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর জন্ম ১৯০৬। হাসান আল বান্নার সুদূরপ্রাসারী চিন্তাবিপ্লব ও তার মাহন আদর্শ। যার হাতে প্রতিষ্ঠা পায় মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন। তাঁর জন্ম ১৯০৬। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী, যার জন্ম ১৯০২। আধুনিক তুরষ্কের স্বপ্নদ্রষ্টা, বর্তমান তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, যার জন্ম ১৯৫৪। মিসরের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি, যার জন্ম ১৯৫১। আর্জেন্টিনার বিশ্ববিখ্যাত মার্কসবাদী বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা যার জন্ম ১৯২৮। আধুনিক চিনের জনক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী নেতা মাও সেতুং, তার জন্ম ১৮৯৩। রাশিয়ার বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা ভ্লাাদিমির লেনিন, (১৮৭০)। সোভিয়েত বিপ্লবী নেতা জেভি স্তালিন (১৮৭৮)।
এসকল মহান ও ভিন্নচিন্তার বিপ্লবী ব্যক্তিদের চিন্তাগত উদারতা ও বৈপ্লবিক আদর্শ আধুনিক পৃথিবীর বিভিন্ন মতাদর্শের লোকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করে দিয়েছে।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে যারা বিভিন্নভাবে বিপ্লব আর নতুন আইডোলজির স্বপ্ন দেখছেন কিংবা চিন্তা করছেন, তাদের জন্য অতীব জরুরী বিষয় হলো ঐ সকল বিপ্লবী নেতার জীবনেতিহাস এবং তাদের কর্মপন্থার সকল অধ্যায় যথেষ্টভাবে পাঠ করা। প্রথমে বুঝতে হবে আমরা কি চাই? বিপ্লবের নামে রাজনৈতিক ময়দানে হুঙ্কার ছুঁড়ে ভেতরে ভেতরে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গোলামী করা? নাকি বাস্তবিক অর্থে নিজেকে শুদ্ধ করে সমাজ পরিবর্তনের বাসনায় আত্মনিয়োগ করা।
ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত করা কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে প্রথমে এমন কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে একটি আন্দোলনের প্রয়োজন, যার বা যাদের ভিত্তি নির্মিত হবে সেই জীবন দর্শন, সেই নৈতিক মানদন্ড এবং সেই চারিত্রিক আদর্শের উপর, যা হবে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কেবল সেসব লোকেরাই ঐ আন্দোলনের নেতা ও কর্মী হবার যোগ্যতা রাখবে, যারা মানবতার এ বিশেষ ছাঁচে ঢেলে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে প্রস্তুত হবে। সেই সাথে যারা সমাজে অনুরূপ মনমানসিকতা ও নৈতিক প্রাণশক্তি প্রচারের জন্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাবে।
অতঃপর এই একই ভিত্তির উপর এমন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা ঐ বিশেষ টাইপের লোক তৈরি করবে। যার থেকে সৃষ্টি হবে এমন সব মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ। মোটকথা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমন সব বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে, যারা নিজেদের মনমানসিকতা, ধ্যানধারণা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম।
পৃথিবীর সব বিপ্লবের ইতিহাস কাছাকাছি ধরণের চিন্তা ও সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠে। একথা আপনাদের অজানা থাকার কথা নয়। একটি বিশেষ ধরণের বিপ্লব ঠিক সেই ধরণের আন্দোলন, অনুরূপ নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী, অনুরূপ সামষ্টিক ও সামাজিক চেতনা এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পরিবেশই দাবী করে।
দেখুন,ফরাসী বিপ্লবের জন্যে সেই বিশেষ ধরণের নৈতিকও মানসিক ভিত রচনারই প্রয়োজন ছিলো, যা তৈরি করেছিলেন রুশো, ভল্টেয়ার ও মন্টেস্কোর মতো দার্শনিক। কার্ল মার্ক্সের দর্শন এবং লেলিন ও ট্রটক্সির নেতৃত্ব আর হাজার হাজার সমাজতান্ত্রিক কর্মীর ত্যাগের বদৌলতেই রুশ বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল, যারা নিজেদের জীবনকে সমাজতন্ত্রের ছাঁচে ঢেলে গঠন করেছিলো। জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রের পক্ষে সেই বিশেষ নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক মাটিতেই শিকড় গাড়া সম্ভব হয়েছিল, যা সৃষ্টি করেছিল হেগেল, ফিস্টে, গ্যেটে এবং নিটশের মতো অসংখ্য চিন্তাবিদদের দর্শন ও মতাদর্শ, আর হিটলারের দুর্র্ধষ নেতৃত্ব। ঠিক তেমনি, ইসলামী বিপ্লবও কেবল তখনি সংঘটিত হতে পারবে, যখন কুরআনী দর্শন ও মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সঃ) আদর্শের ভিত্তিতে একটি প্রচন্ড গণআন্দোলন উত্থিত হবে এবং সামাজিক জীবনের মানসিক, নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিসমূহকে সংগ্রামের প্রচন্ডতায় আমূল পরিবর্তিত করে দেয়া সম্ভব হবে।
এই চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতেই ইসলামী আন্দোলনকে সমাজের বুকে ছড়িয়ে থাকা ভ্রান্ত জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে বিপদ মুসীবত ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, ত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা পেশ করে, মার খেয়ে খেয়ে এবং জীবন দিয়ে দিয়ে নিজেদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও মজবুত হিসেবে প্রমাণ পেশ করতে হবে।
তাদের প্রতিটি কাজ ও ব্যবহার দ্বারা যেনো দুনিয়ার সামনে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এমন নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ, সত্যবাদী, পূতঃ চরিত্র, ত্যাগী, নীতিবান ও খোদাভীরু লোকেরা মানবতার কল্যাণের জন্যে যে আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে, তাতে অবশ্যি মানুষের জন্যে সুবিচার, শান্তি ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
একসময় এক অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতির ফলে সেই কাংখিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে জমীনকে তৈরি করা হয়েছে।
এ হলো সেই বিপ্লবের চিত্র ও সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক পদ্ধতি, যাকে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী রাষ্ট্র বলা হয়।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নেতার কথিত বিপ্লবী চিন্তার সাথে আমার বুঝ ও বোধের কতটুকু পার্থক্য এর সামান্য আমি এখানে তুলে ধরলাম। বাকিটুকু আপনারাই বিবেচনা করুন।
চিন্তা করতে হবে। চিন্তার সাথে আনুগত্য ও অনুপম আদর্শ সদ্বাচরণ অর্থাৎ রাসুল সা. এর সকল উত্তম চরিত্রকে নিজের মধ্যে ফুটিয়ে না তুলতে হবে। অন্যথায় অন্তত ইসলামী বিপ্লব শুধু কাজির কেতাবেই থেকে যাবে। বাস্তবে আর প্রতিফলিত হবে না।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক