রক্তপাতহীন বিপ্লব ‘অহিংস আন্দোলন’
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:১৬:১০,অপরাহ্ন ০৩ জুলাই ২০১৯ | সংবাদটি ৪১৬ বার পঠিত
ডেস্ক:: হংকং এ জুন মাস থেকেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলছে। এই বিক্ষোভের কারণে বিতর্কিত এক প্রত্যর্পণ বিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে সরকার। দেশটির সরকারের এই উদ্যোগ চীনের কাছে হংকং এর ভিন্নমতাবলম্বীদের সম্পর্কে ভিন্ন বার্তা পাঠাতে পারে।
কিন্তু শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মধ্যেই সোমবার কয়েকশ’ তরুণের একটি দল দেশটির পার্লামেন্ট ভবন লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা ভবনের কাচ ভেঙে অধিবেশন কক্ষে ঢুকে পড়ে এবং স্প্রে-পেইন্ট দিয়ে কক্ষের দেয়ালে নানা রকম বার্তা লিখে দেয়।
কেন্দ্রীয় অধিবেশন কক্ষের ভেতরের দেয়ালে হংকং এর প্রতীকের ওপর একজন বিক্ষোভকারী কালো রং ছিটিয়ে দেয়। আরেকজন পুরনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের ইউনিয়ন জ্যাক-আঁকা পতাকা তুলে ধরে।
তবে এসব কিছুর পরেও বলা যায়, হংকং এর বিক্ষোভ এখনো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের দাবী আদায়ের সম্ভাবনা কতটা রয়েছে? এই দাবীর পক্ষে কত মানুষ আছে সেটা একটা বিবেচনা হিসেবে এখানে সামনে আসবেই।
অহিংস আন্দোলন
১৯৮৬ সালে লক্ষ লক্ষ ফিলিপিনো ম্যানিলার রাস্তায় নেমে এসে শান্তিপূর্ণভাবে প্রার্থনা করতে থাকে। সেই বিক্ষোভের চতুর্থ দিনে মার্কোস শাসনামলের অবসান ঘটে। ২০০৩ সালে জর্জিয়ায় রক্তপাতহীন এক বিপ্লব হয়, যেখানে বিক্ষোভকারীরা গোলাপ হাতে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে। এরপর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন শাসক এডুয়ার্ড সেভর্দনাদজে।
এ বছরের শুরুতে সুদান এবং আলজেরিয়ায় শান্তিপূর্ণ সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে বিদায় নেন দেশ দুইটির শাসকেরা। বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি রয়েছে ইতিহাসের নামী বহু রাজনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক এবং আন্দোলনকারীর।
কিন্তু সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট এরিকা চেনোয়েত বলছেন, শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের কেবল নৈতিক জোরই বেশি তা নয়, বরং এ ধরনের আন্দোলন এখন সফল হবার সম্ভাবনাও বেশি।
তিনি বলছেন, হংকং এর মাত্র প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ মানুষ রোজকার বিক্ষোভে রাস্তায় নামছেন। কিন্তু তাদের দাবী সরকারকে শুনতে হচ্ছে এবং ইতিমধ্যেই বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করতে হয়েছে।
কয়েক শতাব্দী দীর্ঘ ইতিহাস
একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে ২০০০ সালে এই গবেষণা শুরু করেন বিশ্লেষক চেনোয়েত, তার সেসময় ধারণা ছিল যে, হ্যাঁ, অহিংস আন্দোলন হয়ত অনেক যুদ্ধের চেয়ে শক্তিশালী ছিল এক সময়।
ভারতের মহাত্মা গান্ধী এবং যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং এর উদাহরণ তিনি জানতেন। কিন্তু সেটা কোন সরকারী সিদ্ধান্ত বর্তমান বিশ্বে কতটা বদলাতে পারবে-দ্বিধা ছিল তার মনে।
কিন্তু ১৯০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন পর্যালোচনা করার পর তিনি উপলব্ধি করেছেন যে অহিংস আন্দোলন দিয়ে বড় পরিবর্তন সম্ভব। যেকোন আন্দোলনের সব দাবী অর্জন হলে সেটাকে একটি সফল আন্দোলন বলা হয়।
এই বিবেচনায় ৩২৩টি সহিংস এবং অহিংস আন্দোলন পর্যালোচনার পর চেনোয়েতের বিশ্বাস এই বিবেচনা শেষ কথা নয় আন্দোলনের সফলতার ক্ষেত্রে।
সংখ্যা দিয়ে বিচার
এরিকা চেনোয়েত বলেন, সামগ্রিকভাবে যেসব আন্দোলনে সহিংসতা হয়েছে তার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি সফল হয়েছে অহিংস আন্দোলন। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৩ শতাংশ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। উল্টোদিকে সহিংস হয়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমে কেবল ২৬ শতাংশ পরিবর্তন এসেছে।
এতে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা কত বেশি ছিল, সেটা অবশ্যই একটি ভূমিকা রেখেছে। গবেষণায় চেনোয়েত দেখেছেন যে বড় ২৫টি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে ২০টিই ছিল অহিংস আন্দোলন। এছাড়া অহিংস আন্দোলনে সাধারণ মানুষের যোগ দেবার হারও বেশি থাকে।
কেন অহিংস আন্দোলন সফল হয়?
চেনোয়েত দেখেছেন কয়েকটি বিশেষ কারণ আছে অহিংস আন্দোলন সফল হবার।
• প্রথমেই আছে এসব আন্দোলনে রক্তপাতের ভয় থাকেনা মানুষের, যেকারণে বহু মানুষ এতে যোগ দিতে পানে
• সহিংস আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য শারীরিক সামর্থ্য একটি বড় যোগ্যতা, কারণ দৌড়ানো বা মারামারি করতে হলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। কিন্তু অহিংস আন্দোলনে সেটার দরকার নেই
• অহিংস আন্দোলনে বিপুল সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কারণে সেটা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের মধ্যেও সহানুভূতি তৈরি করে। এছাড়া বিক্ষোভ দমনের সময় এসব বাহিনীর পরিবারের সদস্যরাও ওই আন্দোলনে থাকতে পারে এমন আশংকা থেকে সহজে হামলা চালানো হয় না
• অহিংস আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা যেকোন সংলাপ বা আলোচনার প্রস্তাবে তুলনামূলক দ্রুত সাড়া দেয়
বিফলতা যত
এগুলো খুব সাধারণ আলোচনা। পৃথিবীতে অহিংস আন্দোলন ব্যর্থ হবার হারও নেহায়েত কম নয়। চেনোয়েত যে একশো বছরের বেশি সময় পর্যালোচনা করেছেন, তার মধ্যে যত অহিংস আন্দোলন হয়েছে, তার অন্তত ৪৭ শতাংশ শেষ হয়েছে কোন সফলতা ছাড়াই।
যেমন পূর্ব জার্মানিতে কম্যুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালে এক অহিংস আন্দোলনে চার লাখের বেশি মানুষ যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি সে আন্দোলন।
সাম্প্রতিক উদাহরণের মধ্যে ২০১১ সালে ব্যাপক জন বিক্ষোভ বাহরাইনে কোন সফলতা পায়নি। কিন্তু এই সফলতা আর ব্যর্থতার ইতিহাসের মধ্য থেকে চেনোয়েত বিশ্বাস করেন সামনের দিনে সহিংস আন্দোলনের চেয়ে নাগরিক আন্দোলনের বড় অংশটি হবে অহিংস। আর তাতে মানুষ সফল হবে বলেও তার বিশ্লেষণ। (সংগৃহিত)