দিল্লি সহিংসতা: ‘স্বামী কেমন, জানতেও পারেননি নববধূ‘
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:২৯:৩৫,অপরাহ্ন ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৫৮৮ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: দুপুরে ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সদ্য বিবাহিত ২২ বছরের আশফাক হুসেন। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁর। দিল্লির উগ্রবাদি হিন্দুদের গুলি কেঁড়ে নেয় তার প্রাণ। আর স্বপ্ন ভেঙে যায় নববধূ তসলিন ফাতিমার।
এদিকে, তিন দিন ধরে গায়ে জ্বর নিয়ে ঘরের কোণে পড়ে রয়েছেন ২১ বছরের তসলিন ফতিমা। ঘুমের মধ্যেও মৃত স্বামীকে বারবার দেখতে পাচ্ছেন তিনি। স্বামীকে জানার-চেনার সুযোগটাই যে মিলল না তার!
পূর্ব দিল্লির গোকুলপুরীর অন্তর্গত মুস্তফাবাদের ঘিঞ্জি গলির এক পাশে কোনও রকমে মাথা গোঁজার একটা জায়গা। সপরিবারে সেখানেই বাস ছিল অশফাক হুসেনের। পেশায় বিদ্যুৎকর্মী তিনি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের সাখনিতে তসলিনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। পরিবার পরিজনকে নিয়ে সবকিছু মেটাতেই বেশ কয়েক দিন লেগে যায়। ভেবেছিলেন সব কিছু মিটিয়েই দিল্লি ফিরবেন। তসলিনকে নিয়ে সেখানেই নতুন জীবনে পা রাখবেন। একে অপরকে চিনবেন, জানবেন।
কাজের প্রয়োজনে রবিবার (২৩ ফেব্রুযারি) রাতে একাই মুস্তফাবাদের নিজ বাড়িতে ফিরেন আশফাক। ঠিক ওই সময়ই জাফরাবাদ এবং মৌজপুরে বিক্ষোভের আগুনে হাওয়া লাগে। উত্তরপ্রদেশেও সে খবর পৌঁছয়।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মুস্তফাবাদে ফিরেন তসলিনও। নতুন বউ হিসাবে ওই দিন তাঁর কাঁধেই রান্নার ভার পড়ে। তা সেরে দপুর ২টা নাগাদ সকলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সারেন। এই প্রথম পাশাপাশি বসে খাওয়ার সুযোগ হয় তসলিন ও আশফাকের।
কিন্তু দুপুরে খাওয়ার পরই একটি ফোন আসে আশফাকের কাছে। বলা হয়, পাড়ায় একটি বাড়িতে আচমকা বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। তাকে গিয়ে দেখতে হবে। সেই মতো ১২ দিনের স্ত্রীকে রেখে বাড়ি থেকে বেরোন আশফাক। পরস্পরকে সেই শেষ দেখা তাঁদের। তার পর আর ফেরা হয়নি আশফাকের।
বাড়ি থেকে কিছু দূর এগোতেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরিবারের লোকজন কিছু জানার আগে স্থানীয়রাই তাঁকে নিউ মুস্তফাবাদের আল হিন্দ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই মৃত্যু হয় তার। ময়নাতদন্তের জন্য পরে গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর দেহ।
কিন্তু শুক্রবার (২৮ ফেব্রুযারি) পর্যন্ত তাঁর দেহ হাতে পায়নি পরিবার।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, রবিবার (২৩ ফেব্রুযারি) রাত থেকেই বন্দুক, লাঠি এবং পেট্রল বোমা নিয়ে মুস্তফাবাদে ঢুকতে শুরু করে তাণ্ডবকারীরা। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশ এবং দমকলবাহিনীকে একাধিক বার ফোন করা হলেও, কারও দেখা মেলেনি।
বুধবার (২৬ ফেব্রুযারি) এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি। এলাকার একটি মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। আগুন ধরানো হয় একটি স্কুলেও। একাধিক বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়।
পুলিশ সময় মতো দায়িত্ব পালন করলে পরিস্থিতি এতদূর গড়াত না বলে দাবি আশফাকের কাকা মুখতার আহমেদ।
গত তিন দিন ধরে ছেলের জন্য কেঁদে চলেছেন আশফাকের বাবা। শুধু নিজের ছেলে নয়, চার দিন ব্যাপী হিংসায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের সকলকে শহিদ ঘোষণা করতে হবে বলে দাবি করেন তিনি। এই পরিস্থিতিতেও সরকার অপরাধীদের কড়া শাস্তি দেবে বলে আশাবাদী তিনি।
আর তসলিন? কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই তিনি। উপরের একটি ঘরে গত তিন দিন ধরে জ্বর নিয়ে পড়ে রয়েছেন। এই তিন দিনে একটি দানাও মুখে তোলেননি। জল পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেননি। মুখে একটাই আফশোস, ‘‘মানুষটা কেমন, তা জানতেও পারলাম না।’’
একসঙ্গে অনেকটা পথ যাওয়ার কথা ছিল দু’জনের। কিন্তু বিয়ের ১২ দিনের মাথাতেই ভেঙে গেল তার সব স্বপ্ন।