স্ত্রী-সন্তান হত্যার পর চিরকুটি, আমার লাশ রেললাইনে পাওয়া যাবে!
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:২৯:১১,অপরাহ্ন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৭৪০ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: রাজধানীর দক্ষিণখানে মা ও দুই শিশু সন্তান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে নেমেই চাঞ্চল্যকর এক আলামত পেয়েছে পুলিশ।
স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার পর নিখোঁজ বিটিসিএল কর্মকর্তার এক চিরকুটি ও হত্যায় ব্যবহৃত হাতুড়ি উদ্ধারও করা হয়েছে। এ চিরকুটিতে লেখা রয়েছে ‘বাচ্চাদের মেরে ফেললাম, আমার লাশ রেললাইনে পাওয়া যাবে।’
শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় দক্ষিণখানের প্রেমবাগান রোডের একটি পাঁচতলা বাড়ির চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় মা মুন্নী বেগম (৩৮), ছেলে ফারহান উদ্দিন ভূঁইয়া (১২) ও মেয়ের লাইভী ভূঁইয়ার (৩) অর্ধগলিত মরদেহ। পুলিশের ধারণা, এর তিন-চারদিন আগে তাদের হত্যা করা হয়।
মুন্নীর মাথায় হাতুড়ির আঘাত ও দুই শিশুসন্তানের গলায় শ্বাসরোধে হত্যার চিহ্ন পেয়েছেন তারা। শিশুদের বাবা বিটিসিএলের উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবউদ্দিন ভূঁইয়া ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ।
এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে নেমে সেই বাসা থেকে একটি ডায়েরি ও একটি হাতুড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। ডায়েরিতে লেখা একটি বার্তাকে ঘিরেই তাদের তদন্ত পরিচালিত হচ্ছে। ডায়েরিতে লেখা রয়েছে- ‘বাচ্চাদের মেরে ফেললাম, আমার লাশ রেললাইনে পাওয়া যাবে।’
লেখাটি শিশুদের বাবা রাকিবউদ্দিন ভূঁইয়ার হতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। তারা এখন নিখোঁজ রাকিউদ্দিনের খোঁজ করছেন।
আর প্রতিবেশীরা ধারণা করছেন, বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করতে না পেরে হতাশ রাকিবউদ্দিনই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তিনি অনলাইনে জুয়া খেলায় ও মাদকে আসক্ত ছিলেন বলেও জানান তারা। এসব কারণে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি টাকা ঋণ করেন। সেসব শোধ করতে না পারায় রাকিবের সংসারে অশান্তি লেগেই ছিল।
অথচ রাকিব-মুন্নী দম্পতির সম্পর্কের শুরুটা ছিল মধুর। মুন্নীর ভাই সোহেল আহমেদ জানান, সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন ছিলেন মুন্নী-রাকিব। প্রেমের সম্পর্কের পরিণতিতে প্রায় ১৪ বছর আগে তারা বিয়ে করেন। দক্ষিণখানের যে ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় সেই বাসায় ২০১১ সাল থেকে ভাড়ায় থাকতেন তারা।
রাকিবের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার ভাতশালা এলাকায়। আর মুন্নীর পৈত্রিক নিবাস মহাখালী ওয়ারল্যাস এলাকায়।
বিটিসিএলের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে রাকিব গুলশান থেকে বিটিসিএলের উত্তরা কার্যালয়ে বদলি হন রাকিবউদ্দিন ভূঁইয়া। যোগদানের পর তিনি অফিস করেছেন কিনা তা জানাতে পারেননি এ বিটিসিএল কর্মকর্তা। তবে ইতোমধ্যে পুলিশ বিটিসিএলে রাকিবের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে বলে জানান তিনি।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মুন্নীর ভাই মুন্না রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে গতকাল ১৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার দক্ষিণখান থানায় মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত সূত্রে জানা যায়, রাকিব বছরখানেক আগে জুয়া ও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়লে তাদের সংসারে অশান্তি দেখা দেয়। বাসার সামনের একটি মুদি দোকানে প্রায় ৪ লাখ টাকা বাকি পড়েছে তার নামে।
এক সহকর্মীর কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা ধার করেন রাকিব। এভাবে আরো বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেন তিনি। সব মিলিয়ে কোটি টাকার ওপরে ঋণ করেছিলেন রাকিব।
এছাড়া মাসকয়েক আগে অপহরণের নাটক সাজিয়ে নিরুদ্দেশ হন তিনি। এ ঘটনায় মুক্তিপণের বিপুল টাকাও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন রাকিব। ওই টাকার বড় অংশই দেয় মুন্নীর পরিবার। সম্প্রতি ওই টাকা ফেরত দেয়ার জন্যও চাপ তৈরি করা হয়। এতে অশান্তি আরো বেড়ে যায়।
প্রায়ই দক্ষিণখানে তাদের ফ্ল্যাট থেকে ঝগড়াঝাটির শব্দ পেতেন প্রতিবেশীরা। আর পাওনাদাররা বাসায় এসে তাগদা দেয়ায় রাকিবের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেন স্ত্রী মুন্নী। এ কারণে তাদের প্রতিদিনই ঝগড়াঝাটি হতো। এসব থেকে মুক্তি পেতেই রাকিব স্ত্রী-সন্তানদের খুন করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা।
ডায়েরিতে লেখা প্রসঙ্গে ডিএমপি’র উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ডায়েরির লেখাটি রাকিবউদ্দিনের বলে মনে হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
এছাড়া ঘটনাস্থলে মুন্নীর লাশের পাশ থেকে একটি হাতুড়ি উদ্ধার করা হয়। ওই হাতুড়ির আঘাতেই মুন্নীর মাথার ভেতর গভীর ক্ষত হয়। গতকাল শনিবার রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে মা ও দুই সন্তানের মৃতদেহের ময়নাতদন্তের পর রাতেই তাদের বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কেএম মাইনউদ্দিন বলেন, ‘মুন্নীর মাথায় পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
এছাড়াও ছেলে ফারহানের গলায় চিকন ফিতা পাওয়া গেছে। এই ফিতা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়েছে ও মেয়েটির গলায় চেপে ধরার চিহ্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এ খুনে রাকিবই জড়িত। তিনি নানা কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এতে তাদের পরিবারে অশান্তি দেখা দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, অশান্তি থেকে মুক্তি পেতেই তিনি স্ত্রী-সন্তানদের খুন করেছেন।’
দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে এমন আশা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে এই খুনের রহস্যভেদ করা সম্ভব হবে।’