ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ: ১৫২৮-২০১৯ ফিরে দেখা ইতিহাস
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:১০:৩৫,অপরাহ্ন ০৯ নভেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৯৪৬ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: ভারতের সবচেয়ে আলোচিত জায়গার মধ্যে অন্যতম উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নির্মিত জায়গা। এ নিয়ে মুসলিম-হিন্দুদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ভয়াবহ দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে। নিহত হয়েছেন কয়েক হাজার লোক। বহু বছর ধরে চলা এই বির্তকের অবসান ঘটাতে শনিবার (৯ নভেম্বর) রায় ঘোষণা করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
বর্তমানের বাবরি মসজিদের জায়গা হিন্দুদের এবং সেখানে রামমন্দির নির্মিত হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে। আর মুসলিমদেরকে মসজিদ নির্মাণের জন্য বিকল্প জায়গা দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ভারতে আবারও বিশৃঙ্খল অবস্থার তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যায় তৈরি হয় বাবরি মসজিদ। মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করেন। হিন্দুদের কিছু সংগঠন দাবি করতে শুরু করে মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে এই মসজিদ। ১৮৫৩ সালে প্রথম এই ইস্যুতে বিরোধ বাঁধে।
১৮৫৯ সালে ব্রিটিশরা একটি প্রাচীর দিয় হিন্দু ও মুসলিমদের প্রার্ধনার জায়গা আলাদা করে দেয়। ৯০ বছর ধরে এভাবেই ব্যবহৃত হয় জায়গাটি। ১৯৪৯ সালে প্রথম এই জমি সংক্রান্ত মামলা আদালতে যায়। সেইসময় রামের মূর্তি স্থাপন করা হয় মসজিদের ভিতরে।
১৯৮৪ সালে রাম মন্দির গড়ার দাবি নিয়ে হিন্দুদের একটি কমিটি তৈরি হয়। তিন বছর বাদে একটি জেলা আদালত নির্দেশ দেয়, যাতে ওই বিতর্কিত এলাকা হিন্দুদের প্রার্থনার জন্য খুলে দেওয়া হয়। মুসলিমরা তৈরি করে বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি। এরপর ১৯৮৯ সালে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ওই স্থানে। ১৯৯০ সালে রাম মন্দির তৈরির সমর্থনে রথযাত্রা করেন এলকে আদবানী।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেয় কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। দেশ জুড়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়। ১০ দিন বাদে তৈরি হয় তদন্ত কমিটি। ১৭ বছর বাদে ২০০৯ সালে সেই কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়। সেই রিপোর্টে আদবানী, বাজপেয়ীসহ ১৭ জনের নাম ছিল। ওই সময় দেশব্যাপী দাঙ্গায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
২০০৩ সালে এই মামলার জন্য আদালত সাতজন হিন্দু নেতাকে তলব করে, তার মধ্যে বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতাও ছিলেন। লখনউতে মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতীর বিরুদ্ধে মামলা চলে। এবছরের জুলাই মাসে ডেডলাইন দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ৯ মাসের মধ্যে এই মামলার রায় ঘোষণা হয়।
২০১০ সালে এলাহবাদ হাই কোর্ট একটি রায় দেয়। তাতে বলা হয় ওই বিতর্কিত জমকিতে তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে। নির্মোহী আখড়া, রাম লাল্লা ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। সেই রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
প্রথমে তিনজন মধ্যস্থতাকারী দেওয়া হয় এই মামলার জন্য। পরে, গত ৬ আগস্ট থেকে প্রত্যেকদিন এই মামলার শুনানি শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপরির বেঞ্চ। ১৬ অক্টোবর সেই শুনানি শেষ হয়।
মামলার বিস্তারিত ইতিহাস:
১৫২৮: মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপ্রধান মীর বাকী বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন।
১৮৮৫ : মহন্ত রঘুবীর দাসবাবরি মসজিদেও বাইরে একটি অস্থায়ী মন্দির তৈরির দাবি জানান। ফৈজাবাদ কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেয়।
১৯৪৯: বিতর্কিত কাঠামোর বাইওে কেন্দ্রীয ডোমের নীচে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়।
১৯৫০: জনৈক গোপাল সিমলা বিশারদ রাম লালার মূর্তি পূজার জন্য জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা কোর্টে আবেদন জানান।
১৯৫৯: এলাকার অধিকার দাবি করে নির্মোহী আখড়া মামলা করে।
১৯৬১: উত্তরপ্রদেশের সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডও এলাকার অধিকার জানিয়ে পাল্টা আবেদন করে।
১৯৮৬ (১ অক্টোবর): স্থানীয় আদালত সরকারকে এক নির্দেশে হিন্দুদের পূজা করার অনুমতি দিয়ে রামলালা যেখানে রয়েছে তার গেট খুলে দিতে বলে।
১৯৮৯: ভগবান শ্রী রামলীলা বিরাজমানের পক্ষে তার সখা এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি দেওকী নন্দন আগরওয়াল আদালতে মামলা করেন।
১৯৯০(২৫ সেপ্টেম্বর): অযোধ্যায় রামমন্দিও নির্মানের লক্ষ্যে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী গুজরাটের সোমনাথ থেকে দেশব্যাপী রথযাত্রা শুরু করেন।
১৯৯২ (৬ ডিসেম্বর): বিজেপি নেতাদের নেতৃত্বে করসেবকদের একটি দল উন্মত্ততার সঙ্গে বাবরি মসজিদকে ধুলিসাৎ করে দেয়।
১৯৯৪ (২৪ অক্টোবর): সুপ্রিম কোর্ট ইসলাম ফারুকির মামলায় এক ঐতিহাসিক রায়ে প্রথম জানায় যে, মসজিদ ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়।
২০০২(এপ্রিল): এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিতর্কিত স্থানের মালিকানা সংক্রান্ত মামলার শুনানী শুরু করে।
২০১০ (৩০ সেপ্টেম্ব): এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২:১ সংখ্যাধিক্যের রায়ে বিতর্কিত জমিকে সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে তিনভাবে ভাগ করার নির্দেশ দেয়।
২০১১ (৯ মে): সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার ভ’মি বিবাদ নিয়ে এলাহাবাদ হাইকের্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়।
২০১৭ (২১ মার্চ): সুপ্রিম কোর্টেও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে কোর্টের বাইরে সমাধান খোঁজার কথা বলেন।
২০১৭ (১ ডিসেম্বর: ২০১০ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ কওে ৩২ জন সিভিল রাইটস অ্যক্টিভিস্ট মামলা করে।
২০১৯ (৮ জানুয়ারি): সুপ্রিম কোট অযোধ্যার বিতর্কিত ভূমি বিবাদ মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, শরদ অরবিন্দ বোরদে, এন ভি রমন, ইউ ইউ ললিত ও ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়কে নিয়ে ৫ সদস্যের সংবিধান বেঞ্চ গঠন করে।
২০১৯ (২৫ জানৃুয়ারি): বিচারপতি ইউ ইউ ললিত এই মামলা থেকে সওে দাঁড়ানোয় সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান বেঞ্জ প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, শরদ অরবিন্দ বোরদে, এস আব্দুল নাজির, অশোক ভ’ষন ও ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়কে নিয়ে পুনর্গঠন করে।
২০১৯ (২৬ ফেব্রুয়ারি): সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতার কথা জানায়। তিন সদস্যের মথ্যস্থতাকারী কমিটি তৈরি কওে দেয়।
২০১৯ (৯ মে): মধ্যস্থতাকারী কমিটি সুপ্রিম কোর্টে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে।
২০১৯ (১ আগষ্ট): মধ্যস্থতাকারী কমিটি সিলকরা ঘামে আদালতে তাদেও রিপোর্ট জমা দেয়।
২০১৯ (৬ আগষ্ট): সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা ভূমি বিবাদ মামলার প্রতিদিন শুনানীর কথা ঘোষনা করে।
২০১৯ (১৬ অক্টোবর): শুনানী শেষ ঘোষনা করে আদালত রায় সংরক্ষিত রাখে।
২০১৯ (৯ নভেম্বর): চূড়ান্ত রায় ঘোষণা।