শিক্ষক-শিক্ষার্থী নেই, তবুও এমপিওভুক্ত!
প্রকাশিত হয়েছে : ২:২৪:৪৫,অপরাহ্ন ২৭ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ৫৮৫ বার পঠিত
কুড়িগ্রাম থেকে সংবাদদাতা:: কুড়িগ্রামে একই ইউনিয়নে একই ধরনের চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবারে এমপিওভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একই মালিকের দুই প্রতিষ্ঠান এমপিও হলেও একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় সদর ইউনিয়নে এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই ৪টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একই মালিকের দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার একটির পরিত্যক্ত ভবন থাকলেও নেই কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী দেখিয়ে এমপিও হবার সুযোগ গ্রহণ করার অভিযোগ উঠেছে। জরাজীর্ণ আর পরিত্যক্ত এই ভবনটি দীর্ঘ ৪-৫ বছর ধরে হাটের গরু রাখাসহ মাদকাসক্তদের অপকর্মের আস্তানা হয়ে উঠেছে।
এমপিওর তালিকায় নাম আসার পরপরই রাতারাতি সোনাহাট ইউনিয়নের ঘুন্টির মোড়ের অন্য প্রতিষ্ঠান উপমা মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটের নাম পরিবর্তন করে এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটের ব্যানার লাগানো হয়েছে। টিনশেড এই প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো শিক্ষার্থী। নেই ক্লাস চলার কার্যক্রম। কাগজ-কলমে পরিচালনা হলেও পরিত্যক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তি তালিকায় কিভাবে গেল এ নিয়ে রয়েছে জনমনে প্রশ্ন। অপরদিকে সদ্য এমপিওভুক্ত হওয়ায় ২৮ শতক জমিতে গড়া এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটে চলছে পরীক্ষা। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের জ্ঞান ছাড়া পায় না কোনো কারিগরি শিক্ষা। এই প্রতিষ্ঠানে ল্যাবসহ কম্পিউটারের সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও এমপিও হয়েছে কম্পিউটার বিজ্ঞান শাখা। কাগজে-কলমে স্থান ও ছাত্র-ছাত্রীর নাম ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ধলডাঙ্গা ইউনিয়নের দিয়াডাঙ্গা টেকনিক্যালের অধ্যক্ষ ফেরদৌসুল আরেফিন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা সদর ইউনিয়নের গরুর হাটের পাশে তার নিজ নামের আদ্যক্ষর (এফএ) নাম দিয়ে একটি মহিলা এবং কিছু দুরে দেওয়ানের খামার এলাকায় একটি সাধারণ টেকনিক্যাল ও বিএম কলেজ খোলেন। একটিতে তার স্ত্রীকে অধ্যক্ষ অপরটিতে তার ছোট ভাইকে অধ্যক্ষ করেন। পরবর্তীতে তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হলে মহিলা বিএম এর অধ্যক্ষ করেন তার চাচাকে। এসব বিদ্যালয়ে দিয়াডাঙ্গা বিএম থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শিক্ষার্থী দেখিয়ে পরীক্ষা দেয়া হয়। এফএ’র দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কয়েক বছর আগে পাসকৃত অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যমান রয়েছে।
এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ মোদ্দাছেরুল ইসলাম বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের মূল জায়গায়টি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায়। আগে উপমা মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউট থাকলেও তাদের কোনো শিক্ষার্থী না থাকায় এটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমরা এক বছর ধরে মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় ২৬ শতক জমিতে গড়া এই টিনশেড ঘরেই এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউট পরিচালনা করছি। টিনশেড এই ঘরগুলোতে ক্লাস পরিচালনার জন্য পাওয়া যায়নি কোনো বেঞ্চ, বোর্ড কিংবা পাঠদানের সরঞ্জামাদি। তার দাবি ক্লাস হয় নিয়মিত। এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ১৯০ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক ৪ জন ও স্টাফ রয়েছে ৬ জন। এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউট ও এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউট নেই কোনো ল্যাব, নেই কোনো কম্পিউটার। এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ পর্যন্ত কোনো কারিগরি প্রশিক্ষণের ক্লাসই করেননি। এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ আল-মামুন ল্যাব ও কম্পিউটার না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসা হচ্ছে। এখানে সরকারি বা বেসরকারি কোনো অনুদান আমরা পাইনি। এখন এমপিও হয়েছে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ২৮ শতক জমিতে স্থাপিত এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক আছে ১২ জন।
স্থানীয় বাসিন্দা, বুলবুলি, রবিউল, মন্টু ব্যাপারী বলেন, এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে ৫ বছর আগে এখানে এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউট ছিল। সেটিও ছাত্র-ছাত্রী না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক ফেরদৌসুল আরেফিন সে নিজেও এমপিওভুক্ত দিয়াডাঙ্গা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। তার বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে রংপুর ও ভূরুঙ্গামারীতে। নতুন এমপিও স্বীকৃতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারই নিজের ছোট ভাই ও চাচাকে অধ্যক্ষ হিসেবে রেখেছেন।
এমপিওভুক্ত না হওয়া মইদাম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রিয়াজুল বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার খেসারত দিতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী শিক্ষকদের। তারা ২২ বছর ধরে এমপিওর আশায় থাকলেও নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে এবার এমপিও।
এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইন্সটিটিউটের মালিক ফেরদৌসুল আরেফিন পরিত্যক্ত ভবনের কথা স্বীকার করে জানান, কাগজপত্র সব ঠিকঠাক রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এনে ভর্তি দেখানো হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কখনই শতভাগ দেখানো সম্ভব নয়। তবে যখন পরিদর্শনে আসে তখন সেগুলোই দেখানো হয়। এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য তিনি একাধিক প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। এরমধ্যে তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানটি আগেই এমপিও ছিল। এবারই তার নিজের দুটি প্রতিষ্ঠান এমপিও হয়েছে। এক কিলোমিটারের মধ্যে বলতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। একই উপজেলায় সর্বোচ্চ ৬টি প্রতিষ্ঠান এমপিও হতে পারে।
ওই দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও একই ইউনিয়নে ভূরুঙ্গামারী টেকনিক্যাল ও বিএম কলেজ, ভূরুঙ্গামারী মডেল টেকনিক্যাল ও বিএম কলেজসহ জয়মনির হাট ইউনিয়নে একটি উপজেলায় মোট ৫টি টেকনিক্যাল ও বিএম কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে। এমপিও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে একই ইউনিয়নে চারটি একই ধরনের প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে অভিমত শিক্ষাবিদদের। অন্যদিকে দীর্ঘদিন থেকে এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় থাকা প্রকৃত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্তি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক বঞ্চিত শিক্ষক।
গত ২৩ অক্টোবর ঘোষিত এমপিও তালিকা অনুযায়ী এইচএসসি বিএম কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ভূরুঙ্গামারীতে-৫টি, চিলমারী দুটি, উলিপুর, রাজারহাট ও রৌমারীতে একটি করে। মাদরাসা আলিমস্তর নাগেশ্বরী ও রাজিবপুরে একটি করে। মাদরাসা দখিলস্তর সদর, ভূরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ি, রাজারহাটে একটি করে। মাধ্যমিক স্তর রৌমারীতে ৭টি, ভূরুঙ্গামারী ও উলিপুরে দুটি করে, চিলমারী, রাজিবপুর, রাজারহাট ও সদরে একটি করে। নিম্নমাধ্যমিক স্তর রৌমারীতে দুটি। উচ্চ মাধ্যমিক (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ফুলবাড়িতে একটি। উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) নাগেশ্বরী একটি। কৃষি প্রতিষ্ঠানে রাজারহাট, উলিপুর, রৌমারীতে একটি করে এবং ভোকেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রৌমারীতে দুটি।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, জেলায় ১৯টি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬টি মাদরাসা ও ১০টি এসএসসি বিএম প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী চারটি শর্ত পূরণ করলে এমপিও পাওয়া যায়। শর্তগুলো হলো- প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির মেয়াদ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হারের ভিত্তিতে অনলাইনে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এমপিও হবার আবেদন করেছেন।
তিনি স্বীকার করে বলেন, জেলায় এখনও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যাদের যোগ্যতা থাকার পরেও এমপিও হয়নি। তবে এমপিও চলমান প্রক্রিয়া সেহেতু পর্যায়ক্রমে হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনলাইনে কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকলেও সরকার বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে পুনর্বিবেচনা করবেন ও ব্যবস্থা নেবেন।