ওসি মোয়াজ্জেমের রায় কবে!
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৩১:৪৮,অপরাহ্ন ২৪ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ৬২২ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় ১৬ আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে গ্রেফতার হন সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এই হত্যাকাণ্ডের রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনের ফাঁসির রায় হয়েছে। আমি বলতে চাই, প্রাথমিকভাবে এটা ‘কমপ্লিট জাজমেন্ট’। তবে যদি সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে এ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হতো, আমি মনে করি, তাহলে এটা পূর্ণতা পেত।
তিনি বলেন, তারপরেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম জেলে আছেন, তার বিচার শেষ পর্যায়ে। তার সাজা যদি কনফার্ম করা হয়, ন্যায় বিচারের মাধ্যমে যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে নুসরাত জাহান রাফির আত্মা পরিপূর্ণভাবে শান্তি পাবে।
গত ১৫ এপ্রিল ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ব্যারিস্টার সুমনের মামলাটি প্রথমে অভিযোগ আকারে ছিল। পরে পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন আদালত। ওসির বিরুদ্ধে থানায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্য ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়াসহ প্রত্যেকটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্তে প্রমাণিত সব তথ্য-উপাত্তসহ প্রতিবেদন আদালতকে দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে ওসির বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ৩১ মে পরোয়ানার চিঠি ফেনীর পুলিশ সুপার কাজী মনির-উজ-জামানের কার্যালয়ে যায়। তবে পুলিশ সুপার বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকেন। তিনি ৩ জুন পরোয়ানা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। এর দুই দিন পর রংপুর রেঞ্জে পরোয়ানা পাঠানো হয়। তখন কাজটি বিধি মোতাবেক হয়নি বলে জানায় রংপুর রেঞ্জ। পুলিশের এমন গড়িমসির মধ্যে আত্মগোপনে যান মোয়াজ্জেম। পরে তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। পরে দীর্ঘ ২০ দিন ধরে আত্মগোপনে থাকার পর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে তাকে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দা পুলিশ।
গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে যান ওই ছাত্রী। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে চার-পাঁচজন বোরকা পরিহিত ব্যক্তি ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে উদ্ধার করে স্বজনরা সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাফি মারা যান। এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া ও মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর আসামি মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন, মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রলীগকর্মী মো. শামীম, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলন সদস্য ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এমরান হোসেন মামুন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ইফতেখার উদ্দিন রানা, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন শাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী কামরুন নাহার মণি।
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু নুসরাতের পরিবার ওই মামলা তুলে নেয়নি। নুসরাত ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন।
গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে যান নুসরাত। ওই সময় কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে তাকে ডেকে নিয়ে যায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সহযোগীরা। পরে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত ৮ এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। পরবর্তীতে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
স্থানীয় প্রভাবশালীরা মামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে বিষয়টি বুঝতে পেরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই।
এরপর ১০ জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। ২৭ ও ৩০ জুন বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসানকে (নোমান) জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার শুনানি শেষ হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর আদালত রায়ের জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন।