হু হু করে ‘ফারাক্কা’ দিয়ে আসছে পানি, ভাসছে উত্তরাঞ্চল!
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৩০:৪৭,অপরাহ্ন ০২ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ৫২৪ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: ভারতের ফারাক্কার সবক’টি লকগেট খুলে দেওয়ায় হু হু করে ধেয়ে আসছে পানি। এতে কুষ্টিয়া ও পাবনায় পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে দুই জেলার শত শত বিঘার ফসল তলিয়ে যাওয়াসহ বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আর রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। এ অবস্থায় চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধির ফলে সংশ্লিষ্ট জেলায় বাড়ছে আতঙ্ক।
পাবনা পাউবোর হাইড্রোলজি বিভাগের উত্তরাঞ্চলীয় নির্বাহী প্রকৌশলী কেএম জহিরুল হক জানান, মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) সকাল ১০টায় পদ্মার পানি বিপদসীমা ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে। সকাল ৯টার পরিমাপ অনুযায়ী পানি বিপদসীমার এক সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাউবো, পাবনার উপসহকারী প্রকৌশলী সানজানা নাজ জানান, ঈশ্বরদীর পাকশীতে হার্ডিঞ্জব্রিজ পয়েন্টে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় পদ্মায় পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয় ১৪ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার। তিনি আরও জানান, গত কয়েকদিন ধরেই পদ্মার বিভিন্ন পয়েন্টে ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। প্রতি ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, মঙ্গলবার সকালে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এদিকে পদ্মায় অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে তীরবর্তী এলাকার প্রায় ৫০০ হেক্টর ফসলি ও নিচু জমি প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজার একর জমির নানা ফসল। ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউপি চেয়ারম্যান রানা সরদার বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। এবার উজানে প্রবল বর্ষণ ও ধেয়ে আসা পানির ফলে পদ্মা নদীর কোমরপুর থেকে সাঁড়াঘাট পর্যন্ত রক্ষা বাঁধের মাত্র ১ ফুট নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পাকশীর ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস জানান, তার ইউনিয়নের রূপপুর সড়কের নিচু অংশের ফসলসহ জমি তলিয়ে গেছে। প্রতিদিনই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ফসলসহ জমি। এখন পর্যন্ত কোনো বসতভিটা ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল লতিফ বলেন, ঈশ্বরদীর সাঁড়া, পাকশী ও লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের আখ, ফুলকপি, গাজর, মাষকলাই, মুলা, বেগুন, শিম, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধানসহ ৪০০ হেক্টর জমির সবজি ও ফসল তলিয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে লক্ষীকুন্ডার দাদাপুর, চরকুরুলিয়া, কামালপুর ও বিলকেদায়। পানি না কমা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করা যাচ্ছে না।
পাবনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, যে গতিতে পদ্মায় পানি বাড়ছে তাতে পূর্ব হতেই ধারণা ছিল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করবে। পদ্মার গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলোতে সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৬ বছর পর বিপদসীমা অতিক্রম করল পদ্মার পানি। সর্বশেষ ২০০৩ সালে এই পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছিল। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর, চিলমারির, ফিলিপনগর ও মরিচা ইউনিয়নের বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ। পানি ঢুকে পড়েছে ভেড়ামারা উপজেলার মসলেমপুর ইউনিয়নে। পাশাপাশি কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কোমরকান্দি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পদ্মায় পানি বাড়ায় গড়াই নদীতে পানি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। জিকে ঘাট ছাড়াও বড় বাজার এলাকার বেড়িবাঁধের পাশে বেশ কিছু ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। পানি বাড়তে থাকলে কুষ্টিয়া রক্ষা বাঁধসহ অন্যান্য স্থাপনা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত জিওব্যাগ ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, ভারত সরকারের হঠকারী এমন সিদ্ধান্তে প্রমত্তা পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। হার্ডিঞ্জব্রিজ পয়েন্টে পানির বিপদ সীমা ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। সোমবার দুপুর ৩টায় হার্ডিঞ্জব্রিজ পয়েন্টে পানির লেবেল ছিল ১৪ দশমিক ১০ সেন্ট্রিমিটার। বিপদসীমা শূন্য দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার পানি কম ছিল এ পয়েন্টে। কিন্তু ফারাক্কার সবক’টি লকগেট খুলে দেওয়ার কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার দুপুর ৩টায় পানির লেভেল ছিল ১৪ দশমিক ২৭ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পীযুষ কৃষ্ণ কুন্ডু বলেন, পানি এ মুহূর্তে বিপদসীমার কয়েক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পর ভেড়ামারা উপজেলার মোসলেমপুরে পানি ঢুকছে। এছাড়া কুষ্টিয়া শহর, কুমারখালী ও খোকসার কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করে ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে পারে।
জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, নদীর পানির উচ্চতা বাড়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির পারিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিনিয়ত রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে প্রতি ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের একাধিক টিম ঘটনাস্থলে আছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রস্তুত রয়েছে। আরও ত্রাণ প্রয়োজন হলে আসবে।
রাজশাহীতে মঙ্গলবার দুপুরে বিপদসীমা থেকে মাত্র ৪১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। নদীতে এখন রয়েছে প্রচ- স্রোত। ইতোমধ্যে রাজশাহীর চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, মঙ্গলবার বেলা ৩টায় পদ্মায় পানির উচ্চতা ছিলো ১৮ দশমিক ০৯ মিটার। এর আগে দুপুর ১২টায় পদ্মার পানির উচ্চতা ছিলো ১৮ দশমিক ০৭ মিটার। আর ভোর ৬টায় ছিলো ১৮ দশমিক ০৪ মিটার। রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। আর সোমবার ভোর ৬টায় পানির উচ্চতা ছিলো ১৭ দশমিক ৯০ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় পানি বাড়ে ১৪ সেন্টিমিটার। আর ২৭ ঘণ্টায় বাড়ে ১৫ সেন্টিমিটার।
পানি বৃদ্ধির কারণে রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট, পবা ও গোদাগাড়ী উপজেলার চরাঞ্চলের বেশকিছু গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। বাঘার চরাঞ্চলের ১১টি স্কুল গত রোববার থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে জানান, পানিবন্দি এসব মানুষকে সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, এরই মধ্যে গোদাগাড়ীর ৭৬টি ও চারঘাটের ২৬টি পরিবারকে পদ্মার চর থেকে এপারে আনা হয়েছে। আরও যেসব পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদেরও আনা হবে। তিনি বলেন, পদ্মার পানি বাড়লে রাজশাহীর চরাঞ্চলেই বেশি বন্যাকবলিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে পানি শহরে প্রবেশ করবে না।