কাশ্মীরের ৭০ বছরের ইতিহাস পাল্টে গেলো!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩১:৩১,অপরাহ্ন ০৫ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ১৬৫৫ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: ভারতের বিজেপির সরকার কাশ্মীরের ৭০ বছরের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। বিতর্কিত ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের (আইওকে) বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে ভারত।
রাজ্যটিতে ভারী নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই সোমবার (৫ আগস্ট) সংসদে কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত রাজ্যে রূপান্তরের ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এমন একটি পদক্ষেপ ভারত শাসিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের অধিবাসীদের মধ্যে ভয়, শঙ্কা ও ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। এখন থেকে কাশ্মীরে প্রতি ৫ বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কেন্দ্রের মতো। কেন্দ্র ঠিক করবে সেখানে পুলিশের কী ক্ষমতা হবে। কেন্দ্র সেখানে অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা জারি করার ক্ষমতা পাবে। জম্মু-কাশ্মীরের দ্বৈত পতাকা ব্যবস্থা বাতিল হতে যাচ্ছে। স্বতন্ত্র আইন বাতিল হতে যাচ্ছে। বিজেপির মূল শক্তি হিন্দুত্ববাদ, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিতে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্তির মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের বীজ বপন হয়ে যাবে।
জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে লাদাখকেও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তবে সেখান থেকে কোন সাংসদ থাকবে না কেন্দ্রে। সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে বাতিলের মাধ্যমে এই ঘোষণা আসে, যার ফলে এখন থেকে বিধান অনুযায়ী এই অঞ্চলের বাইরের অর্থাৎ অন্যান্য রাজ্যের ভারতীয়রা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু-কাশ্মীরে জমি কেনা বা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে পারবে। আর এটাই কাশ্মীরিদের উদ্বেগের বিষয়।
সোমবার রাজ্যসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। আজকের পরে এ বিষয়ে নিম্ন সভায় বক্তব্য দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যে অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরে সায়ত্বশাসন ও বিশেষ অধিকার প্রদান করা হতো। ভারতের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই কাশ্মীরকে এই অস্থায়ী বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আসা হচ্ছে। মোদীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, সরকার কাশ্মীরের দীর্ঘকালীন ‘অস্থায়ী’ এই অধিকারগুলোকে বাতিল করে দেবে।
জম্মু-কাশ্মীর ও ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের ইতিহাস
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ ছিল না। জম্মু-কাশ্মীর ছিল মহারাজা হরি সিং-এর স্বাধীন রাজতন্ত্র। তবে, ১৯৪৭ সালের ২২শে অক্টোবর কিছু পার্বত্য দস্যুরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে, রাজা হরি সিং ভারতের কাছে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’ অর্থাৎ ভারতভুক্তির শর্তে সেনা সাহায্য চেয়েছিলেন। যাতে জম্মু-কাশ্মীরকে অস্থায়ী ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়। সে সময়ে বিনা অনুমতিতে কাশ্মীরে কেউ প্রবেশ করতে পারতো না।
রাজা হরি সিং প্রাথমিক ভাবে স্থির করেছিলেন তিনি স্বাধীন থাকবেন, এবং সেই মোতাবেক ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে স্থিতাবস্থার চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। পাকিস্তান সে চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিল। কিন্তু জনজাতি এবং সাদা পোশাকের পাক সেনা যখন সে দেশে অনুপ্রবেশ করে, তখন তিনি ভারতের সাহায্য চান, যা শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ঘটায়। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরদিন, ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭, গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সে চুক্তি অনুমোদন করেন।
এ ব্যাপারে ভারতের বক্তব্য ছিল, এই ভারতভুক্তির বিষয়টি কোনও একজন শাসকের মতামতের ভিত্তিতে স্থির হতে পারে না, এর জন্য সে জায়গার অধিবাসীদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, ‘আমার সরকার মনে করে, কাশ্মীর আক্রমণকারীদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই সে রাজ্যের ভারতভুক্তির বিষয়টি রাজ্যের অধিবাসীদের দ্বারা স্থিরীকৃত হওয়া উচিত।’
কাশ্মীরের ভারতভুক্তি যে সাময়িক সিদ্ধান্ত, তা ১৯৪৮ সালে জম্মু-কাশ্মীর সম্পর্কিত শ্বেত পত্রে ঘোষণা করে ভারত সরকার। ১৭ মে ১৯৪৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল এবং এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের সম্মতিক্রমে জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাকে একটি চিঠি লেখেন। সে চিঠিতে তিনি বলেন, ভারত সরকারের স্থির সিদ্ধান্ত হল জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান সে রাজ্যের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। সেই মতামতের প্রতিনিধিত্ব বহন করার উদ্দেশ্যেই গণপরিষদ গঠিত হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর একটি ব্যতিক্রমী রাজ্য কারণ প্রতিরক্ষা,পররাষ্ট্র বা যোগাযোগের মতো কয়েকটি বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সেখানে ভারতের কোনও আইন প্রয়োগ করতে গেলে রাজ্য সরকারের সম্মতিও জরুরী।
নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিকানা বা মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও এই রাজ্যের বাসিন্দারা দেশের বাকি রাজ্যের তুলনায় বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করে থাকতো, আর ৩৭০ ধারার অধীনেই তাদের সে অধিকার দেয়া হয়েছিল। এই ৩৭০ ধারার ভিত্তিতেই নিহিত ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাস।
কাশ্মীরে এখন কী ঘটছে?
এ জাতীয় পদক্ষেপের সমালোচকরা বলছেন যে, ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিল করার মাধ্যমে বিজেপি বহুদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের শুরু করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে হিন্দু বাসিন্দাদের নতুন এক জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, মুসলিমদের কাশ্মীরকে হিন্দুত্ববাদী রাজ্যে পরিণত করার বিজেপির জনমিতিক লক্ষ্যের অংশই হচ্ছে এমন পদক্ষেপ বলে জানায় পাকিস্তানের ডন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলার নামে এই অঞ্চলটিতে যেকোন জনসমাবেশেকে নিষিদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে। রাজ্যজুড়ে বাড়ানো হয়েছে সুরক্ষা ব্যবস্থা, নতুন করে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত প্রায় ৬০ হাজার সেনা। রবিবার গভীর রাতেই ভারত সরকার আইওকে-এর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এবং মেহবুবা মুফতিকে গ্রেপ্তার করে। ইন্টারনেট ও ফোন পরিষেবাদি বিচ্ছিন্ন করে এই অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
বিশেষ মর্যাদাটা কী ছিল?
৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। এই ধারাবলে জম্মুকাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ ১ ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেয়া হয়। এই ধারা বলে ওই রাজ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের ক্ষমতা সীমিত। ভারতভুক্তি সহ কোনও কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্যের মত নিলেই চলে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের একমত হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভাজন করে ভারতীয় সাংবিধানিক আইন কার্যকর হওয়ার সময়কাল থেকেই ভারতভুক্তির বিষয়টি কার্যকরী হয়।
ওই আইনে তিনটি সম্ভাবনার কথা রয়েছে। প্রথমত স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকে যাওয়া, দ্বিতীয়ত, ভারতের যোগদান অথবা, পাকিস্তানে যোগদান। এ ব্যাপারে কোনও লিখিত ফর্ম না থাকলেও, কী কী শর্তে এক রাষ্ট্রে যোগদান করা হবে, তা রাজ্যগুলো স্থির করতে পারত। অলিখিত চুক্তি ছিল, যোগদানের সময়কালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষিত না হলে, দু পক্ষই নিজেদের পূর্বতন অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে।
৩৭০ ধারা থেকেই প্রবাহিত হয়েছে ৩৫এ ধারা, যা ১৯৫৪ সালের রাষ্ট্রপতির নির্দেশের মাধ্যমে কার্যকর হয়। ৩৫এ ধারানুসারে, জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দা বলতে কী বোঝায়, তাদের বিশেষ অধিকারগুলো কী কী, এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার জম্মু কাশ্মীর বিধানসভার ওপর ন্যস্ত রয়েছে।
৩৫এ অনুচ্ছেদটি ভারতের অন্য রাজ্যের নাগরিকদের কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন, জমি কেনা, স্থানীয় সরকারী চাকুরী পাওয়া বা ওই অঞ্চলে শিক্ষাবৃত্তি অর্জনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এই ধারা অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভাই ঠিক করতে পারত, রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কারা এবং তাদের বিশেষ অধিকার কী ধরনের হবে। জম্মু-কাশ্মীরের কোনও নারীরা রাজ্যের বাইরে কাউকে বিয়ে করলে তিনি সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। অর্থাৎ তাঁর সম্পত্তিতে আর কোনও অধিকার থাকত না। এমনকি, তার উত্তরাধিকারীরাও ওই সম্পত্তির মালিকানা বা অধিকার পেতেন না।
আর্টিকেল ৩৫এ অপরিবর্তিত রয়েছে, কিন্তু কয়েক দশক ধরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর কিছু আইনে মিশ্রণ ঘটেছে। ৩৫ এ অনুচ্ছেদে সমালোচকরা বলছেন যে, এই বিধানটির সংসদীয় অনুমোদন ছিল না এবং এটি নারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে।
বিজেপির উদ্দেশ্য কী?
শুরু থেকেই ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীর, যে অঞ্চলটির দাবিদার পাকিস্তান, অংশবিশেষে চীন ও। তবে, ভারতের অংশই বড়, আশির দশক থেকেই মুসলিম রাজ্যটি স্বাধীনতার দাবিতে বিদ্রোহ শুরু করে। ভারত সরকার এই বিদ্রোহকে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ও আইএসআই-এর তত্ত্বাবধানে জঙ্গিবাদ বলে দাবি করে আসছে, এবং সেখানে ব্যাপক নজরদারির আওতায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শুরু থেকেই কাশ্মীরের বিশেষ অধিকারের বিরোধিতা করে আসছিল, এবং এটা প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-এর ইশতেহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কাশ্মীর। সেখানেই তারা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদকে বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল, যাতে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাদ হয়।
বিজেপি ২০১৯ এর ইশতেহারে বলেছিল, ‘বিগত পাঁচ বছরে, আমরা জম্মু-কাশ্মীরে স্থিতিশীলতা ও শান্তি আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও দৃড় নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সকল প্রচেষ্টা করেছি। আমরা উন্নয়নের পথে আসা সমস্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে এবং রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান সরবরাহ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা জন সংঘের সময় থেকে আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল করার বিষয়ে আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি’। বিজেপি’র সেই ইশতেহারে অনুচ্ছেদ ৩৫এ ও বাতিল করার বিষয়ে বলা হয়েছিল, যা কাশ্মীরিদের বিশেষ কিছু অধিকার প্রদান করে থাকে।
২০১৬ সালে মোদী প্রথম শাসনামলে ভারত সরকার কাশ্মীরে হিন্দুদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করে। যা নিয়ে তখন ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন বিবিসি’র একটি প্রতিবেদনে বলে, ভারত শাসিত কাশ্মীর থেকে উগ্রপন্থীদের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু পরিবারগুলোকে সে রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য সরকার।
৯০ এর দশকের গোড়া থেকেই কাশ্মীরী পন্ডিতসহ হিন্দু পরিবারগুলো উপত্যকা ছেড়ে জম্মু বা দিল্লি অথবা ভারতের অন্যান্য এলাকায় চলে গিয়েছিল। এখন তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কলোনি তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে, এই নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। হিন্দুদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন কলোনির বিরোধীতা করছেন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারাও।
রাজ্যের বিজেপি ও পিডিপি সরকার তখন পরিকল্পনা করেছে কাশ্মীরী পন্ডিতদের আবারও উপত্যকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে। তাদের জন্য সাময়িক ট্র্যান্সিট ক্যাম্প বানানোর কথা বলা হচ্ছে– যতদিন না কাশ্মীরী হিন্দু পরিবারগুলো নিজেদের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে নিতে পারছে।
কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা পন্ডিতদের স্বাগত জানালেও তাদের জন্য পৃথক কলোনি তৈরি সরকারি পরিকল্পনার বিরোধীতায় একজোট হয়ে গেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুক বিবিসিকে বলছিলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীরের সমস্ত মানুষই চান যে কাশ্মিরী পন্ডিতরা ঘরে ফিরে আসুন। এটা একটা মানবিক সমস্যা। কিন্তু যে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে– পন্ডিতরা ফিরে আসবেন, কিন্তু তা-ও তাদের আলাদা শিবিরে রাখা হবে। এতে তো দূরত্ব ঘুচবে না, বরং বাড়বে। তাই এরকম কোনও ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে ওনারা বাকিদের সঙ্গে মিলে মিশেই থাকতে পারেন। কোনও পৃথক ব্যবস্থা করে যেন সর্ম্পকের মধ্যে দেয়াল তুলে না দেওয়া হয়।’
কাশ্মীরে একসময়কার পালিয়ে যাওয়া হিন্দু পরিবারগুলো ফিরছে, এরই মধ্যে হঠাৎ করে কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেয়ায় সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। এমনকি কাশ্মীর এখন হিন্দু সাংসদ পেতে যাচ্ছে। নানান আশঙ্কায় রয়েছে কাশ্মীরের মুসলিম সম্প্রদায়, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার সেখানে হিন্দুদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করবে, এই অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে সেখানে অন্য রাজ্যের নাগরিকদের জমি কেনার, আবাসনের, চাকরির পথ সুগম করেছে।
এই আইন বাতিলে কী প্রভাব পড়বে কাশ্মীরে?
৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের একটি ‘টেম্পোরারি প্রভিশন’ বা অস্থায়ী সংস্থান। এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছিল, অনুচ্ছেদ বাতিলের সঙ্গে তাও বাতিল। আগে জম্মু-কাশ্মীরের প্রাদেশিক ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ছিল না কেন্দ্রের, এখন থেকে যে ক্ষমতা পেল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যটি ভেঙে তৈরি হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ নামের দুটো আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।
দেশটির সংবিধানের ১১ নম্বর অংশে অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল এবং বিশেষ সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ীই জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সংবিধানের ধারাগুলো অন্য সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও জম্মু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরে রাজ্যপালের জন্য সদর-এ-রিয়াসত চালু ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বদলে ছিল প্রধানমন্ত্রী। যদিও ১৯৬৫ সালের পর তা উঠে যায়। আবার ১৯৫৬ সালে সংবিধানের ২৩৮ ধারা উঠে যায়। এই ধারায় দেশীয় রাজ্যগুলো (প্রিন্সলি স্টেট) তুলে দিয়ে সাধারণ রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সেই সময়ও জম্মু কাশ্মীরকে এর বাইরে রাখা হয়। অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর ‘প্রিন্সলি স্টেট’ হলেও তা তুলে দিয়ে সাধারণ প্রদেশ হিসেবে গণ্য করা হয়নি।
৩৭০ ধারা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে জম্মু কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল না কেন্দ্রের। এমনকি, কোনও আইন প্রণয়নের অধিকার ছিল না কেন্দ্র বা সংসদেরও। আইন প্রণয়ন করতে হলে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সহমত নিতে হত।
ভারতীয় সংবিধানে ৩৬০ ধারায় আর্থিক জরুরি অবস্থার সংস্থান রয়েছে। কিন্তু জম্মু কাশ্মীরে সেটা সম্ভব ছিল না। ৩৭০ ধারার অধীনেই ছিল ৩৫এ ধারা। এই ৩৫এ ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাও বিশেষ সুবিধা পেতেন। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। কিনতে হলে অন্তত ১০ বছর জম্মু-কাশ্মীরে থাকতে হত। এ বার যে কোনও রাজ্যের বাসিন্দা সেখানে জমি কিনতে পারবেন।
স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া জম্মু কাশ্মীরে অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও। কে স্থায়ী বাসিন্দা এবং কে নয়, তা নির্ধারণ করার অধিকার ছিল রাজ্য বিধানসভার ওপরেই ন্যস্ত।
সোমবার রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামার জেরে এই ৩৭০ ধারা এবং তার অধীনে থাকা ৩৫এ ধারা বিলুপ্ত হয়ে গেল। ফলে সব দিক থেকেই বিশেষ মর্যাদা হারাল জম্মু-কাশ্মীর। দিল্লি, গোয়ার মতো দেশের বাকি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে আর কোনও পার্থক্য থাকল না জম্মু-কাশ্মীরের। অর্থাৎ, ভারতের একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরও অদূর ভবিষ্যতে হয়তো একটি হিন্দু প্রদেশে পরিণত হতে পারে।