সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের সৌধ ও ভাস্কর্য – ১ : অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য সড়ক স্মৃতিফলক
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১২:২৩,অপরাহ্ন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | সংবাদটি ৩৭৪৫ বার পঠিত
আনোয়ার শাহজাহান :
ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান নামে স্বাধীন দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারতের দুই পাশে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে আলাদা ভূখ- নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। স্বাধীনতার স্বাদ বুঝে ওঠার আগেই পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যসহ নানাবিধ শোষণ ও অত্যাচার। বিভিন্ন সময়ে এই এলাকার মানুষের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে চাইলে বাংলার দামাল ছেলেরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে সমুন্নত রাখে। বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের মানুষ যখন নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সচেষ্ট, ঠিক তখনই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইতিহাসের নিকৃষ্টতম প্রথম আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভয়াল সেই কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা নির্বিচারে হত্যা করে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের। কারণ, ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে ’৫২ হয়ে গোটা ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছেন। সে কারণেই পাকিস্তানি বাহিনীর বেশি আক্রোশ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো পর্যায়ের সদস্যদের ওপর। তাই ২৫ মার্চ কালরাতে, বিশেষ করে হিন্দু ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানোর জন্য জগন্নাথ হলে পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করলে সেই রাতে অন্যদের সাথে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যও শহিদ হন।
শহিদ এই বুদ্ধিজীবীর জন্ম ১৯৪১ সালের ৩১ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার জন্তরী গ্রামে। তিনি ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান থেকে ¯œাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৭ সালে ফলিত পদার্থবিদ্যায় এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সহকারী আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কলম্বো পরিকল্পনার আওতায় তিনি শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু সেই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে লন্ডনে আর যাওয়া হয়নি তাঁর। কারণ, লন্ডনে যাওয়ার উদ্দেশে তাঁর বিমানে ওঠার কথা ২৬ মার্চ ভোরে। অথচ সেদিনই নিভে গেল অনুদ্বৈপায়নের জীবনপ্রদীপ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোররাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষকসহ অসংখ্য মানুষকে। অনুদ্বৈপায়ন তাঁদেরই একজন, যাঁকে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ভবনের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে জগন্নাথ হলের গণকবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ শহিদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পাঠাগারের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহিদ অনুদ্বৈপায়ন পাঠাগার’ নামে। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধে শহিদ এই কৃতী বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিকে চিরজাগরূক করে রাখার জন্য স্বাধীনতার পর নবীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে তাঁর গ্রাম জন্তরী পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘অনুদ্বৈপায়ন সড়ক’ নামে। তবে সেই সড়ক এখন কলেজ রোড নামেই অধিক পরিচিত। এখন আর সড়কের কোথাও চোখে পড়ে না অনুদ্বৈপায়নের নাম। এমনকি অনুদ্বৈপায়ন সড়কের নামফলকটিও দেখা যায় না কোথাও। এতে নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরি ও জাতির বীর সন্তানদের সম্পর্কে জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শহিদ এই বুুদ্ধিজীবী ছাত্র হিসেবে যেমন মেধাবী, শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। বেঁচে থাকলে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বিশিষ্ট একজন গবেষক হিসেবে খ্যাতি লাভ করতেন, এমনটাই আশাবাদ ছিল তাঁর সহকর্মী শিক্ষকদের। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাঁর আপনজনেরা জানতেন না, অনুদ্বৈপায়ন জগন্নাথ হলের গণকবরে সমাহিত হয়েছেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, যেহেতু ২৬ মার্চ ভোরে তাঁর বিমানে উড়ে লন্ডনে যাওয়ার কথা, তাই তিনি হয়তো লন্ডনেই আছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি অনুদ্বৈপায়নের বাবার কাছে আসে। তাতে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে পাঠানো ২ হাজার টাকার চেক সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছ থেকে উত্তোলনের জন্য ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের পরিবারের সদস্যরা তখনই নিশ্চিত হন যে তাঁদের প্রিয়জন একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদ হয়েছেন। তখনো তাঁরা আশায় বুক বেঁধে ছিলেন, হয়তো-বা তিনি বেঁচে আছেন এবং লন্ডনেই অবস্থান করছেন। হয়তো কোনো এক দিন বাড়িতে ফিরে আসবেন। পরবর্তী সময়ে অনুদ্বৈপায়নের বাবা দিগেন্দ্র ভট্টাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রমনা থানা থেকে তাঁর বড় ছেলে বাবা অনুদ্বৈপায়নের মৃত্যুসনদ সংগ্রহ করেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়নের কথা জানেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জগন্নাথ হলের সংসদ ভবনের নাম রাখা হয়েছিল ‘অনুদ্বৈপায়ন ভবন’। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবে ভবনটি ভেঙে পড়ায় অনেক ছাত্রের মৃত্যু হয়। নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে পুনর্নির্মিত ভবনটির নাম রাখা হয় ‘অক্টোবর ভবন’। তবে জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ বর্তমান অক্টোবর ভবনের একটি কক্ষের নাম ‘শহিদ অনুদ্বৈপায়ন পাঠাগার’ নামকরণ করে তাঁর স্মৃতিকে অমরত্ব দিয়েছে।
২০০০ সালে নবীগঞ্জ গণপাঠাগারের উদ্যোগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হাবিবুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদী ও সিলেট মদন মোহন কলেজের অধ্যক্ষ আবুল ফতেহ ফাত্তাহর প্রচেষ্টায় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক উজ্জ্বলকুমার দাশের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মৃত্যুঞ্জয়ী প্রজ্ঞাবান শহিদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মারকগ্রন্থ। সেই গ্রন্থে অনুদ্বৈপায়নকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা সময়ের কাছের মানুষেরা।