কোন দিকে হাঁটছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৫৫:১৩,অপরাহ্ন ১১ জুন ২০১৯ | সংবাদটি ১৩০৭ বার পঠিত
।। আরাফাত রহমান।।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা আমাদের দেশের ক্ষমতায় আছে এবং দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা তো আর সবসময় থাকবে না, একদিন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছেড়ে দিতে হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে? ভাবিনি তো? কিন্তু ভাবা উচিত। কেননা ওদের উপরই আগামীর বাংলাদেশ অর্পিত হতে যাচ্ছে।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাদের নিয়ে আমরা একটি অনন্য এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। যাদের ওপর ভরসা করে আমরা সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে পালস্না দেয়ার চিন্তা করি। যাদের আমরা এক বুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ বলে আখ্যায়িত করি। কিন্তু আসলে তাদের কাছ থেকে আমরা যে ভবিষ্যৎ আশা করি, সেটার কি আদৌ কোনো নূ্যনতম বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি? আমার তো মনে হয় পাচ্ছি না। আমরা তাদের স্বপ্ন দেখাই। তারাও সেই স্বপ্ন দেখেও। কিন্তু সেটা যে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিন্দুমাত্র টেরও পাচ্ছি না। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষার মান এবং উদ্ভট সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।
একটা জাতি কোনোদিনই উন্নতি লাভ করতে পারবে না যতদিন পর্যন্ত না তারা শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে উন্নত হবে।
এ সম্পর্কে আমি খুব সংক্ষেপে কিছু কথা বলি। প্রথমেই আসি শিক্ষার কথায়। একটা জাতির উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার শিক্ষার মান যখন অনুন্নত, তখন কীভাবে আমরা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি? এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আবর্তিত হয় জিপিএ-৫, বিসিএস, ব্যাংক জব আর সরকারি চাকরিকে ঘিরে। এটাকে আমরা জীবনমানের জন্য শিক্ষা না বলে জীবিকার জন্য একটা কোর্সও বলতে পারি। এতে কোনো সমস্যা নেই। সবাই এগুলোর পিছনে ছুটতে ছুটতে শিক্ষাগ্রহণের যে আলাদা একটা উদ্দেশ্য থাকে, সেটাই ভুলে যাই। জাপানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের দেশের তৃতীয় শ্রেণির সমমান ক্লাস পর্যন্ত বাচ্চাদের নৈতিক জ্ঞান শিক্ষা দেয়। আর এই বয়সে আমাদের বাচ্চারা কাঁধের ব্যাগভর্তি বইয়ের ভারে নুইয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে যেন এক একজন বাচ্চা পড়ে পড়ে এই বয়সেই বিদ্যাসাগর হয়ে যাবে। শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকে না। আমাদের পারিপার্শ্বিক সবকিছুতেই শিক্ষা থাকে। যেটা জীবনমানের জন্য দরকার হয়। আমরা তো এভাবে সেই শিক্ষা পাইনি। আমাদের শিশুরা কি পাচ্ছে?
তারপর আসি সংস্কৃতির কথায়। এটার সম্পর্কে একটু বেশি বলব। এ দেশের সংস্কৃতি অনেক আগেই লোপ পেয়েছে ওপারের দাদাদের সংস্কৃতির দ্বারা। তারপরও একটা সুশীলসমাজ মনেপ্রাণে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে রাখতে গিয়েও পারছে না এই ফেসবুক-ইন্টারনেটের যুগে। আর বাচ্চারা পারবে কীভাবে? এখন আসি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মর দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে সেই বিষয়ে। ওরা এই ফেসবুক-ইন্টারনেট আর টিকটকের যুগে ওদের আলাদা একটা নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরি করেছে। ওদের সেই সংস্কৃতিতে আছে কিছু বিকৃত টাইপের পরিভাষা। যেমন- মাম্মা, what’s up, awesome, lul, dude , প্যারা এধরনের কিছু শব্দ। আরও আছে উদ্ভট কিছু চুলের কাটিং, তার মধ্যে আবার উদ্ভট কালার, মাথায় ঝডঅএ ক্যাপ, গলায় ভারী ভারী চেন, দশ আঙ্গুলে ২০টা বিভিন্ন কালারের আংটি, হাতের কব্জি থেকে ধরে কনুই পর্যন্ত রকমারি ব্রেসলেট, চকচকে কালারের (গাঢ় লাল, গাঢ় নীল, হলুদ, বেগুনি) প্যান্ট, তার মধ্যে আবার ১০-১২টা জোড়াতালি লাগানো, জগার, লোফার, এগুলো হচ্ছে ওদের সংস্কৃতিতে আধুনিক পরিধেয় জিনিসসমগ্র। তারপর ৪-৫টা ফেসবুক একাউন্ট, ডযধঃ’ং ধঢ়ঢ় একাউন্ট, ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট, জানের জিগার (ওদের ভাষায়) ৪-৫টা বন্ধু। মিনিটে মিনিটে ওদের সঙ্গে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিতে হয়। যার ক্যাপশন থাকে এমন যে ‘হায় ফ্রান্স, কেমন লাগছে আমাদের, কমেন্ডে জানান’, অথবা ‘খেতে গিয়ে এইমাত্র একটা পিক নিলাম, কেমন হইলো বন্ধুরা’, অথবা ‘আমার বন্ধু আজ নতুন শার্ট কিনছে, কেমন হইছে বন্ধুরা’, অথবা ‘বাজারে যাচ্ছি বন্ধুরা, টয়লেটে যাচ্ছি বন্ধুরা, আমি এখন ঘুমাবো বন্ধুরা’, এই ধরনের।
ওদের আবার সমবয়সী কয়েকটা গার্লফ্রেন্ডও থাকে। সেই গার্লফ্রেন্ড আবার ছ্যাকা দিয়া চলে যায়। তারপর সে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় যে, ‘সবচেয়ে বড় ভুল করছিলাম তোমাকে ভালোবেসে’, অথবা ‘পিয়া তোমাকে ভুলতে পারি না’, অথবা ‘কি দোস ছিল আমার, আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেলে’, এই ধরনের ক্যাপশন দিয়ে। ওদের একজনের জ্বর হলে অন্যজন নাপা খায়। এই বয়সেই ওরা একে অপরের জন্য জীবন দিতে রাজি হয়ে যায়। ওরা আবার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে ইভ টিজিংও করে। সিগারেট তো ওদের কাছে খুব সাধারণ ব্যাপার। বিভিন্ন উপলক্ষে ওরা ইয়াবা-বিয়ারও সেবন করে থাকে। এটাই ওদের কাছে আধুনিকতা।
আসুন সতর্ক হই, সতর্ক থাকি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি। তারা যেন কোনোভাবেই ভুল পথে না যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখি। দেশ ও সমাজের দায়িত্ব তাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করে। আসুন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি এবং সোনালি প্রজন্ম তৈরি করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়