সামাজিক উন্নয়নে সিএসআর ও ফাউন্ডেশন যেভাবে কাজ করে
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:২৮:০৭,অপরাহ্ন ০৭ অক্টোবর ২০১৬ | সংবাদটি ২০০৩ বার পঠিত
আমীর খসরু : পৃথিবীর সব দেশেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্পোরেট স্যোশাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) বা সামাজিক দায়বদ্ধতা খাত থেকে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দান বা অনুদানের অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। ফাউন্ডেশন জাতীয় বিভিন্ন সহায়তাকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানও একই ধরণের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে দান বা অনুদান করে থাকে। সিএসআর ফান্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীতে ধনী দেশগুলো সর্বপ্রথম এই ধরনের ফান্ডের ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তী সময়ে কর্পোরেট ব্যবসা জগতের সবাইকে এই উদ্যোগে সপৃক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সিএসআর ফান্ড ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু নিদের্শনা থাকে। তবে মুনাফামুখী ব্যবসার ক্ষেত্রে অর্জিত মুনাফার একটি অংশ সিএসআর কাজের জন্য রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়। আবার প্রতিষ্ঠানের Stakeholders ও মানব সম্পদ উন্নয়নমূলক কাজে ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিএসআর ফান্ড ব্যবহার হয়ে থাকে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, মধ্যযুগীয় সভ্যতা থেকে মানুষ অনুভব করতে শিখে যে ব্যবসা একটি লাভজনক অস্তিত্ব। আর তখন থেকেই মানুষ মূলত মুনাফামূখী ব্যবসার পিছনে ছুঁটতে থাকে। এভাবে কালের বিবর্তনে মানুষ তার ব্যবসা থেকে আরো বেশি মুনাফা পেতে আশা করে। একটি সময় মানুষের সৃজনশীল চিন্তাধারার যে সেলুলয়েড ফিতা থাকে সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে স্বার্থপর মানসিক চিন্তাকে ধারণ করে থাকে। এই ধারাতেই পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষগুলো সামাজিক সমস্যার বেড়াজালে ক্রমান্বয়ে বন্দি হয়ে পড়ে। শুরু হয় ব্যক্তিগত সুখের জন্য ব্যক্তিস্বার্থের ব্যবসা। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে আচ্ছাদিত বেষ্টনীকে ঘিরে রাখা পৃথিবীর সম্পদকে শুধু ব্যক্তিগত সুখের জন্য ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ চলে যেতে থাকে সীমিত কিছু মানুষের হাতে। আর অর্ধেক সম্পদ থাকে পৃথিবীর বাকী সব মানুষের কাছে। একটি সময়ে পৃথিবীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভারসাম্য দুর্বল হয়ে পড়ে। আর তখনই পুঁজিবাদী অর্থনীতির নীতি প্রণেতারা তাদেরই তৈরীকৃত অর্থনীতির স্বার্থপর ভাষায় ‘দান’ বা ‘অনুদান’ শব্দের ব্যবহার শুরু করে। মানুষের স্বার্থপর মানসিকতার যে নির্দেশনা থাকে তাতে ধরে ফাটল। মানুষের স্পর্শকাতর অনুভূতিকে জাগ্রত করার কারণেই গড়ে উঠে ফাউন্ডেশন বা সিএসআর ফান্ড। এরূপ ফান্ড ব্যবহার করে অনেকেই সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে শিখে আবার অনেকের স্বার্থপর মানসিক চিন্তার পরিবর্তনও ঘটতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে দান বা অনুদান অর্থের ব্যবহার ও তার উন্নয়ন মূলক কাজের স্থায়িত্ব কাল নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কারণ এ ধরনের অর্থ জীবনে একবার ব্যবহৃত হয়ে নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। ফলে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে কোনো ভুমিকা রাখতে পারে না। অর্থনীতি শাস্ত্রের স্বার্থপর ভাষার প্রকৃত রহস্যকে ভেদ করে মানব সভ্যতার কাছে প্রশ্ন জাগে, যেখানে দান বা অনুদানের অর্থ ব্যবহার করে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে। পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছলতা বা সক্ষমতা তৈরী করা সম্ভব। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উপায়ে গবেষণা শুরু হয়। কারণ, দান বা অনুদানের অর্থের সহায়তায় উন্নয়নমূলক কাজের যে পরিকল্পনা থাকে তা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। কারণ এ জাতীয় অর্থের উদ্দেশ্য থাকে সামাজিক উন্নয়নের জন্য লোক দেখানো কাজে অংশগ্রহণ আর তাদেরই পরিকল্পনার মরন ফাঁদে আটকে পড়ে অসহায় মানুষ আর এই ধরণের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের তৈরীকৃত কাঠামোর স্তম্ভকে ভেঙে ফেলে।
একবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে যখন পৃথিবী ধবংসের খুব কাছাকাছি ঠিক তখনই পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষদের কাছে একটি নতুন বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হলেন, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। যিনি সামাজিক ব্যবসার একজন পথ নির্দেশক। তিনি সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তাঁর সারাটি জীবন অসহায় দরিদ্র ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার বেড়াজালে আটকে থাকা মানুষদের সাথে মিশে দেখতে পেয়েছেন যে, সামাজিক শক্তির যোগানদাতা শুধু সীমিত কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রয়োজনে রস আহরণ করে এক সময়ে তাদের নিঃশেষ করে ফেলে। আবার দান বা অনুদানের সহায়তায় তাদের শক্তিকে ফিরে পেতে কাজ করে। গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক বলয়ের জন্য একটি উদ্দেশ্য থাকলে সামাজিক শক্তি একটি গন্তব্যের ঠিকানায় পৌঁছতে পারে।
সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমেই সামাজিক সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের যতসব কাঠামো থাকে সেখানে সামাজিক ব্যবসার শক্তি কাজ করে এবং রাষ্ট্রকে আত্ম-নির্ভরশীল করে তোলে।
সিএসআর বা ফাউন্ডেশন জাতীয় প্রতিষ্ঠান যে ধরনের কাজ করে
ফাউন্ডেশন দান বা অনুদানের অর্থ দিয়ে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চ্যারিটি সংস্থা । পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য সেবা, প্রযুক্তি, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, পরিবেশ দূষণ, পুষ্টি ও খাদ্য, জলবায়ু, বন্যা, নারীর ক্ষমতায়ন, জনসংখ্যা ইত্যাদি হাজারো সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। সমাজের এই সব সমস্যা সমাধানে চেষ্টা না করে আমরা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অনুদান বা দানের অর্থ দিয়ে লোক দেখানো সামাজিক উন্নয়নের কথা বলে থাকি।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ জাতীয় দাতা সংস্থার অনুদান বা দানের অর্থ দিয়ে কোনো সামাজিক সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করা যায় না। কারণ, সামাজিক সমস্যা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা একদিনে তৈরি হয় না। পৃথিবীকে রক্ষার জন্য যে সকল প্রাকৃতিক উপাদানের যোগসূত্র থাকে তাতেই বিচ্যুতি ঘটে হাজারো সমস্যার সৃষ্টি হয় । আবার একটি সময়ে তা স্থায়িত্ব পেয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি বলয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সমস্যার গভীরতা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য স্থায়ী পদক্ষেপ নেবার প্রয়োজন হয়।
মানব সভ্যতার প্রাচীন সংস্কৃতিকে ঘিরে সামাজিক ও জনকল্যাণমুখী কাজের মধ্যে পারস্পরিক সু-সম্পর্ক ও সহযোগিতার যে বলয় গড়ে উঠে তা বিলীন হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বার্থপর ভাষাকে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ব্যবহারের ফলে মানুষের মাঝে সৃজনশীল চিন্তাধারার যে নির্দেশনা থাকে সেখানে ধীরে ধীরে স্বার্থপর চিন্তার প্রতিফলন ঘটে ।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সামাজিক ব্যবসা হল সামাজিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপযুক্ত ও টেকসই হাতিয়ার। কারণ ব্যবসাটি তৈরী করা হয়ে থাকে সামাজিক সমস্যাকে সমাধানের উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্যবসা তার উৎপাদিত পণ্য বা সেবা দিয়ে একটি বা অধিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে। একটি সময়ে বিনিয়োগের অর্থ বিনিয়োগকারীকে ফেরত দেয়। পাশাপাশি ব্যবসাটি নিজেই নিজের আর্থিক সক্ষমতা ধরে রাখে চিরদিন। পরবর্তীতে লভ্যাংশের অর্থ দিয়ে ঠিক একই উদ্দেশ্যে অন্য জনপদে নতুন ব্যবসা তৈরী করে।
যেভাবে দানের অর্থ ব্যবহার হয়ে থাকে
জীবন চৌধুরী রাষ্ট্রের সমাজকল্যাণমূলক কাজের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি। তিনি তাঁর জরাজীর্ণ ও দারিদ্র্য কবলিত জনপদে বসবাসরত মানুষদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার উদ্যোগ নেন। বিদেশী দাতা সংস্থা নাইকি ফাউন্ডেশন থেকে স্বাস্থ্য সেবামূলক কাজের জন্য এক লক্ষ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দান হিসেবে পান। উক্ত সহায়তার অর্থ দিয়ে তিনি একটি হাসপাতাল তৈরী করে সমাজের বসবাসরত মানুষদের চিকিৎসা সেবা দেন। এইভাবে বছর দুয়েক উক্ত হাসপাতালের কার্যক্রম চালু রাখতে গিয়ে তিনি আর্থিক সংকটে পড়েন এবং প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। হাসপাতাল তৈরীর বিজনেস মডেল ছিল দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। এভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুনরায় কোনো অনুদানের অর্থ পেতে ব্যর্থ হয়। জীবন চৌধুরী নিজের কিছু অর্থ দিয়ে কোনোভাবে কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করেন। তৃতীয় বছরের শেষ দিকে হাসপাতালটি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জীবন চৌধুরী জনপদে বসবাসরত মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য যে সামাজিক উদ্যোগ নেন তা নিঃসন্দেহে ভালো একটি কাজ। আবার নাইকি ফাউন্ডেশনের এই ধরনের সামাজিক ও মানবিক কাজের আয়ুকাল মাত্র দুই বছর থাকে।
নাইকি ফাউন্ডেশনের অনুদানের সহায়তার অর্থে নির্মিত হাসপাতালের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক কাজে ভূমিকা রাখা। কারণ, অনুদানের সহায়তায় যে-কোন ব্যবসার ধরন থাকে একটি এনজিও’র মতো । এজন্য ব্যবসাটি অনুদানের সহায়তার উপর নির্ভরশীল থেকে গঠন করা হয়। অনুদানের অর্থের স্থায়ীত্বকাল ওয়ান টাইম। তাই হাসপাতালের কোনও আর্থিক সক্ষমতা তৈরী হয়নি । ফলে অর্থের ঘাটতি দেখা দেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির শাস্ত্রে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো স্থায়ী শব্দের অর্থ ব্যবহার করা হয় না । তাই নাইকি ফাউন্ডেশনকে আবারও কোনো সেবা প্রদানের জন্য তাকে দানের অর্থ সংগ্রহ করতে হয়।
পর্যালোচনা
জীবন চৌধুরী সামাজিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনপদের মানুষদের চিকিৎসা সেবার জন্য যে উদ্যোগ নেন তা নিঃসন্দেহে ভালো। আবার নাইকি ফাউন্ডেশন যে উদ্দেশ্য নিয়ে উক্ত হাসপাতালের জন্য অনুদানের সহায়তা অর্থ দেয়, একাজে উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক কাজে ভূমিকা রাখা। বাস্তবিক অর্থে এধরনের কাজ সামাজিক সমস্যা সমাধানে কোনো কাজ করে না। বরং সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের আরো বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।
নাইকি ফাউন্ডেশনের অর্থে কীভাবে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো
স্বাস্থ্য সেবা অপ্রতুলতা আমাদের একটি জাতীয় সমস্যা। রাষ্ট্রের জনগণের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন চাহিদার মধ্যে একটি মৌলিক চাহিদা হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান শর্তই হলো, রাষ্ট্র তার জনগনের সামাজিক নিরাপত্তার সব ধরনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলে থাকেন, দান বা অনুদানের অর্থ দিয়ে স্থায়ীভাবে কোনো সামাজিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়না। কারণ সামাজিক সমস্যা একটি স্থায়ী সমস্যা। এই জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন পড়ে দীর্ঘমেয়াদী স্বচ্ছ পরিকল্পনা আর চিহ্নিত সমস্যা সমাধানে ব্যবসা তৈরীর জন্য বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করা।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, উদ্যোক্তা যে উদ্দেশ্য নিয়ে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য মন স্থির করে থাকে, ঠিক তেমনি একজন বিনিয়োগকারী একই উদ্দেশ্যে চিহ্নিত সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসলেই তখনই সামাজিক ব্যবসাটি কাজ করতে শুরু করে। অর্থাৎ উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগকারী একই উদ্দেশ্য নিয়ে চিহ্নিত সমস্যা সমাধানের জন্য উভয়েই সম্মিলিতভাবে সামাজিক ব্যবসা তৈরী করে। একটি সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এক বা অধিক সামাজিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়। প্রস্তাবিত ব্যবসার উৎপাদিত পন্য বা সেবা দিয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান হয়। আবার, উৎপাদিত পন্য বা সেবা বিক্রয় করে ব্যবসার অর্জিত মুনাফার অর্থ দিয়েও চিহ্নিত সমস্যার সমাধান করা হয়। কারণ, সামাজিক ব্যবসার মুনাফা বিনিয়োগকারী বা উদ্যোক্তা কখনো নিতে পারে না।
আবার, নাইকি ফাউন্ডেশনের দানের অর্থ দিয়ে একটি সামাজিক ব্যবসা ফান্ড তৈরী করে উক্ত ফান্ড সামাজিক ব্যবসার হাসপাতালে বিনিয়োগ করা হলে হাসপাতাল তার আর্থিক সক্ষমতা ধরে রাখে। এই জাতীয় দান বা অনুদানের বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবসার ধরন থাকে একটি প্রচলিত মুনাফামুখী ব্যবসার মতই। চিহ্নিত সামাজিক সমস্যা সমাধানে ভুমিকা রাখার পাশাপাশি আর্থিক সক্ষমতা ধরে রাখে। এক্ষেত্রে বিজনেস মডেল হয়ে থাকে সামাজিক সমস্যায় আক্রান্ত চিহ্নিত মানুষদের ক্রয় ক্ষমতাকে বিবেচনা করে উক্ত ব্যবসার উৎপাদিত পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারণ করা। কারণ সামাজিক ব্যবসার উদ্দেশ্যেই থাকে চিহ্নিত সমস্যাকে সমাধান করা এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে তার বিনিয়োগের অর্থ অর্জিত মুনাফার অংশ থেকে একটি সময়ে ফেরত দেয়া। এ জাতীয় ব্যবসায় সামাজিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাইকি ফাউন্ডেশন বিনিয়োগের ফেরতকৃত অর্থ আবার অন্য একটি ব্যবসা বা একই ধরণের এবং একই উদ্দেশ্য নিয়ে বা বর্তমান ব্যবসাকে আরও বর্ধিতকরণের জন্য বিনিয়োগ করতে পারে। কারণ সামাজিক ব্যবসার অর্থের আয়ুষ্কাল হচ্ছে অনন্তকাল!
অনুদানের অর্থ দিয়ে সামাজিক ব্যবসার হাসপাতাল কীভাবে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে
ডার্বিন একটি ট্রাস্ট। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই ট্রাস্টের উদ্দেশ্য হল, গ্রামীণ জনপদে বসবাসরত মানুষদের ভালো এবং উন্নত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত গেটস্ ফাউন্ডেশন এক মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ডার্বিন ট্রাস্টকে উক্ত স্বাস্থ্য সেবা কাজের জন্য অনুদান দিতে সম্মত হয়। ডার্বিন ট্রাস্ট তাদের প্রস্তাবিত ব্যবসার পরিকল্পনা মোতাবেক ফরিদপুর জেলার টগরবন্দ ইউনিয়নে দু’টি জেনারেল হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। গেটস্ ফাউন্ডেশন প্রাথমিকভাবে তাদের অনুমোদিত অর্থ এই মর্মে বরাদ্দ করে যে ডার্বিন ট্রাস্ট বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে বসবাসরত মানুষদের চিকিৎসা সেবার জন্য দু’টি সাধারণ হাসপাতাল তৈরী করবে। এই জন্য প্রদও সমুদয় অর্থ ব্যয় করা হবে হাসপাতাল নির্মাণ ও ক্যাপিটাল মেশিনারীর জন্য। ডার্বিন ট্রাস্ট তাদের সামাজিক ব্যবসার ফান্ড থেকে উক্ত অর্থ দিয়ে সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। তাদের বোর্ড মেম্বার অব ট্রাস্টি এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তারা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত গ্রামীণ জনপদের বসবাসরত মানুষদে চিকিৎসা সেবা দিতে প্রাথমিকভাবে দুটি জেনারেল হাসপাতালে বিনিয়োগ করবে যা সামাজিক ব্যবসার হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করবে।
তাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফরিদপুর জেলার নির্ধারিত এলাকা পরিদর্শন করে ও পরবর্তীতে সম্মানিত বোর্ড মেম্বারদের নিকট একটি সার্ভে রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, উক্ত জনপদের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে এবং ৩০ শতাংশ মানুষ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। এই জনপদের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে এখনও বঞ্চিত। পাশাপাশি জনপদে বসবাসরত মানুষদের চিকিৎসা সেবার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দেয়ার মতো তেমন সামর্থ্য নেই। এলাকার বাসিন্দারা শারীরিক বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে বসবাস করে। উক্ত জনপদের সাথে শহুরে যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোন সুযোগ নেই, ফলে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের রোগের লক্ষণ মারাত্মক আকার ধারন করে। ফলে অনেকেই মৃত্যু ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। আবার অনেক এলাকার মানুষরা বিশেষত নদীর চর এলাকায় বসবাসরত মানুষরা স্বাস্থ্য সেবা সমন্ধে তেমন ধারণা রাখে না। স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির জন্য উক্ত জনপদের বসবাসরত মানুষেরা স্বাস্থ্য সেবামূলক কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বোর্ড মেম্বার অব ট্রাস্টি এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তারা উক্ত হাসপাতালের জন্য দুই ধরণের চিকিৎসা সেবা দেবে।
হাসপাতালে পাবলিক রিলেশনস অফিসার (হেলথ) নিয়োগ দেয়া হয় এবং সাথে পাঁচজন করে মোট দশজন ফিল্ড অফিসার (হেলথ) নিয়োগ দেয়া হয়। পাবলিক রিলেশনস অফিসার তাঁদের উক্ত দূর্গম এলাকার বসবাসরত মানুষদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ক্যাম্পিং এর জন্য সবাইকে ট্রেনিং দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে হাসপাতালের কাজ ও সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। বোর্ড মেম্বার অফ ট্রাস্টি উক্ত জনপদে বসবাসরত মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে দুই ধরনের সেবা দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
স্বাস্থ্য সেবামূলক কাজের মাধ্যমে যেভাবে চিকিৎসা সেবা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জনপদে বসবাসরত মানুষদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য দু’ভাবে সেবার মূল্য নির্ধারণ করে। যেখানে ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবার অর্থাৎ মোট চিকিৎসা বাজেটের ৬০ শতাংশ রোগীকে নির্ধারিত মূল্যের প্যাকেজ অফার করে। আর অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ রোগী যাদের অর্থ দেওয়ার সামর্থ নেই এবং ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে যাদের হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে শুধু তাদেরই হাসপাতাল থেকে একটি টোকেন ফি মাত্র ৫ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, যারা প্যাকেজের মাধ্যমে সেবা নিতে আগ্রহী এবং যারা টোকেন ফি’র মাধ্যমে সেবা পাবে- এ ক্ষেত্রে উভয়ের চিকিৎসার মান একই ধরনের হবে। উভয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকবে শুধু খাবার এবং একোমেডেশনসহ অন্যান্য লজিস্টিকে। কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবসা শুরুর আগেই তাদের টার্গেট রোগী কারা এবং কীভাবে তাদের চিকিৎসা সেবা দেবে সে দিকগুলি তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ফিজিবিলিটি রিপোর্ট তৈরি করে। আবার সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সেবার মান নিশ্চিতকরণ এবং সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের স্বাস্থ্য সেবার জন্যই উক্ত হাসপাতাল সামাজিক ব্যবসা হাসপাতাল হিসেবে তৈরী করা হয়েছে।
প্রথমত, জনপদের হতদরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একজন ডাক্তার সহ ফিল্ড অফিসারদের (হেলথ) নিয়ে গ্রামীণ জনপদে চিকিৎসা সেবা সমন্ধে ক্যাম্পিং করবে। যারা খুবই গরীব তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা, আবার অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা ও সাশ্রয়ী মূল্যে ঔষধ সরবরাহ এবং তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট ‘ক্যাম্পিং চিকিৎসা কার্ড’ দিয়ে উক্ত সেবার জন্য আজীবন সদস্য করা হবে। উক্ত ৪০ শতাংশ ‘ক্যাম্পিং চিকিৎসা কার্ড’ জাতীয় রোগীদের জন্য যে- সকল প্রয়োজনীয় সেবার ফলে যতটুকু খরচের ঘাটতি হয়ে থাকে সেই পরিমাণ অর্থ সমন্বয় করা হবে প্যাকেজের আওতায় চিকিৎসা নেওয়া ৬০ শতাংশ রোগীর নির্ধারিত প্যাকেজ মূল্যের অর্থ দিয়ে। তারপরও উক্ত ঘাটতি, প্রশাসনিক খরচ এবং ঔষধের মূল্য সহ সবকিছু সমন্বয় করার পরেও উক্ত হাসপাতাল দু’টি বাৎসরিক ১০ শতাংশ মুনাফা অর্জন করে। সামাজিক ব্যবসার তৃতীয় নীতিমালায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে “ বিনিয়োগকারী শুধু তার বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরৎ পাবে, এর বাইরে কোনো লভ্যাংশ নিতে পারবে না”। উক্ত নীতিমালা অনুযায়ী জমাকৃত লভ্যাংশের অর্থ থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগামী তিন বছরের মধ্যে ডার্বিন তার বিনিয়োগের পুঁজি ফেরত দেবে।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা সবাই নিশ্চিত যে, অনুদানের অর্থ দিয়ে স্থায়ীভাবে সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা কোনো কাজ করে না। আর অনুদানের অর্থ কখনো অনুদান প্রদানকারী সংস্থার হাতে ফিরে আসে না। বাস্তবিক অর্থে অনুদানের অর্থ স্থায়ীভাবে কোনো কাজে লাগে না। পৃথিবীতে অনেক ধরনের সংস্থা আছে যারা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অনুদান দিয়ে থাকে। বাস্তবিক অর্থে, এগুলো সমস্যা সমাধানে কোনো কাজ করে না বরং আক্রান্ত মানুষদের আরো বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। পুঁজিবাদী শাস্ত্রের ভাষা তাদেরই প্রয়োজনে সাজাতে পেরেছে কেবলই দান আর অনুদানের তৈরীকৃত জালে শুধু লোক দেখানো খয়রাতি অর্থ দিয়ে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ। অর্থনীতির স্বার্থপর ভাষার নির্দেশনা’য় মানুষের সামাজিক আর মানবিক মূল্যবোধের যে স্পর্শকাতর অনুভূতি থাকে সেগুলো পরিবর্তন করে স্বার্থপর চিন্তার যে গভীর দৃষ্টি থাকে একটি সময়ে তারই ফ্রেমে বন্দি হয়ে পড়ে। আবার অতি উৎসাহী বা কৌতুহলী হয়ে আমরাও তাদেরই দৃশ্যমান দৃষ্টির আড়ালে আটকা পড়ি।
অর্থনীতির ভাষা কাদের জন্য কাজ করে? সামাজিক সভ্যতা আমাদের কি এইভাবে নির্দয় বা নিষ্ঠুর ভাষার ব্যবহার করতে শিখিয়েছে?
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ফাউন্ডেশন তাদের অর্থ দিয়ে ‘সামাজিক ব্যবসার ফান্ড’ তৈরী করে সেই অর্থ সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হলে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক ভাবে অনেকেই এগিয়ে আসবে। আবার সামাজিক ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের ফলে সামাজিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ব্যবসাটির আথির্ক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়ে আবার ঠিকই বিনিয়োগের সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে ফেরত চলে আসে। তাছাড়া এ জাতীয় সংস্থাকে অনুদানের অর্থ সংগ্রহ করতে কখনও বেগ পেতে হয়না। কারণ, সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগিত একটি পুঁজি অনন্ত সময় ধরে পৃথিবীর মানুষকে সামাজিক সমস্যা সমাধানে সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যবহার করা। এ ধারাতে চললে পৃথিবীতে সামাজিক সমস্যার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে যতসব প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়ে আবার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভরপুর ভাবে ঢেলে সাজিয়ে রাখা যাবে। প্রকৃতি প্রদত্ত যতসব নৈসর্গিক উপকরণ যা শুধু মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে তেমনি মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আবারও একই উদ্দেশ্যে প্রকৃতির সাথে অবগাহন করে আবার বিলিয়ে দেয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, নাইকি ও গেটস্ ফাউন্ডেশনের প্রথম ও দ্বিতীয় নির্দেশনার গন্তব্যের পথের মধ্যে দ্বিতীয় গন্তব্যটি হলো বাস্তবিক অর্থে সামাজিক কাজ!
[লেখক : মহাব্যবস্থাপক, ইউনূস সেন্টার, ঢাকা, amir.khashru@yunuscentre.org]