ব্রিটেনে সেক্টর বেইসড ভিসা চালুর সুপারিশ
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:০২:২১,অপরাহ্ন ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ১৯৪৮ বার পঠিত
খাত ও অঞ্চলভিত্তিক ভিসা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে ব্রিটেনের ‘অল-পাটি পার্লামেন্টারি গ্রুপ অন স্যোশাল ইন্টিগ্রেশন’। ব্রিটেনে আসার আগেই নিজ দেশে ইংরেজী ভাষা শেখা, নতুবা ব্রিটেনে এসে অনতিবিলম্বে ইমিগ্রেন্টদের ইংরেজী ভাষা শেখার কোর্সে ভর্তি হওয়ার নিয়ম চালু করারও সুপারিশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমপি ও লর্ডদের সমন্বয়ে গঠিত পার্লামেন্টের এই গ্রুপ। ব্রিটেনের সামাজিক সংহতি বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদনের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত ৫ জানুয়ারি ব্রিটিশ একাডেমী ইন লন্ডনে এসব সুপারিশের কথা তুলে ধরেন গ্রুপের চেয়ারম্যান চুকা উমুনা এমপি। এই প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক এক মাস আগে গত ৫ ডিসেম্বর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সামাজিক সংহতি বিষয়ক একই ধরণের পৃথক একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। জনসংখ্যার দিক দিয়ে ব্রিটেন যত বেশী বৈচিত্র্যময় হচ্ছে, ব্রিটেন ততো বেশী বিভক্ত হয়ে পড়ছে- এমন পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে ‘কেইসি রিভিউ’ নামে পরিচিত ওই তদন্তের প্রতিবেদনেও ইংরেজী ভাষা শিক্ষা প্রসারে কার্যক্রম বিস্তৃত করার সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তবে মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পার্লামেন্টারি গ্রুপের সুপারিশকে স্বাগত জানালেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের উদ্যোগে গঠিত কেইসি রিভিউয়ের প্রতিবেদনে ধর্ম, বর্ণ ও ইমিগ্রেশনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অতিমাত্রায় আলোকপাত করা হয়েছে বলে সমালোচনা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব এলাকায় ইমিগ্রেশন বেড়েছে, সেসব এলাকার জনগণের সাথে কথা বলে এবং সামাজিক সংহতি বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে পাঁচ মাস সময় নিয়ে তৈরী করা অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রতিবেদনে কানাডায় প্রচলিত ব্যবস্থার আলোকে ব্রিটেনেও স্থানীয় ও আঞ্চলিক চাহিদাভিত্তিক ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান চুকা উমুনা সামাজিক সংহতিকে টু-ওয়ে-স্ট্রিট হিশাবে আখ্যা দিয়ে বলেন, সংহতি সৃষ্টিতে মাইগ্রেন্টদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমন ব্রিটেনেরও দায়িত্ব রয়েছে ইংরেজী ভাষা শিক্ষায় বিনিয়োগ করা। ইমিগ্রেশন বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিভিন্ন জাতি (ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড) ও অঞ্চলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে পার্লামেন্টারি গ্রুপ বলেছে, এর ফলে ইমিগ্রেশন ইস্যুতে সারা দেশের জন্য অভিন্ন (ওয়ান-সাইজ-ফিটস-অল) ব্যবস্থাকে বাতিল করে এই বিষয়ে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক বিতর্কের সূচনা করা যেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ করা হলে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে দেশের ইমিগ্রেশন নীতি নিয়ে আস্থা সৃষ্টি হবে এবং রাজনীতিবিদরাও স্থানীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে ইমিগ্রেশনের ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। কানাডার ইমিগ্রেশন নীতির উল্লেখ করে অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই দেশের প্রাদেশিক সরকারগুলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ইমিগ্রেশনের নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করে থাকে। সেখানকার মতো সুনির্দিষ্ট অঞ্চল কিংবা সুনির্দিষ্ট সেক্টরের জন্য ভিসা পদ্ধতি বাস্তবায়ন দেখতে চায় ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি গ্রুপ। বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে চুকা উমুনা বলেন, অল-পার্টি গ্রুপে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) এমন কিছু এমপি আছেন যারা স্কটল্যান্ডের সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে আরও বেশী ইমিগ্রেন্ট চান, কিন্তু ব্রিটেনের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানকার মানুষ ইমিগ্রেশন কমিয়ে আনতে চায়। উমুনা বলেন, ইমিগ্রেশন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে ইমিগ্রেশন বিষয়ক বিতর্ক থেকে বিষাক্ত উপাদান দূরীভূত হবে এবং ওয়েস্টমিন্সটার থেকে জনগণের কাঁধে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে তা মেনে নিতে বলা হবেনা।
ব্রেক্সিটের পর গৃহিত ইমিগ্রেশন নীতি দেশের সামাজিক সংহতিতে কী প্রভাব ফেলে, সেটি খতিয়ে দেখতে সরকারের মন্ত্রীদের প্রতি আহবান জানিয়ে পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সন্ত্রাস দমনের বিষয়গুলোর সাথে জড়িয়ে যেন ইমিগ্রেশন নীতিকে গুলিয়ে ফেলা না হয়। তবে ইমিগ্রেন্টদের সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে ব্রিটিশ সমাজে কট্টরপন্থী ও ঘৃণা প্রচারকারীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেও স্বীকার করা হয়েছে রিপোর্টে।
এদিকে, অল-পার্টি গ্রুপের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় হোম অফিসের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, স্থানীয় চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে ভিসা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা হোমে অফিসের নেই। তবে ইংরেজী ভাষা প্রশিক্ষণ বৃদ্ধিতে হোম অফিস আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে বলে জানান হোম অফিসের মুখপাত্র। সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, স্থানীয় বিভিন্ন কাউন্সিলকে ইমিগ্রেশনের প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহারের জন্য ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণ তহবিলের আওতায় ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের সেক্রেটারি জেনারেল হারুন খান অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ অন ইন্টেগ্রেশন এর প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন: “সম্প্রতি প্রকাশিত অন্য রিপোর্টের মতো এটি নয়, এতে বেশ কিছু বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন সুপারিশ রয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সংহতি পরিকল্পনা, ইকোনমিক মাইগ্রেন্টদের জন্য প্রশিক্ষণ ও ইংরেজী ভাষা শিক্ষার ক্লাস, ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারণের লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ, কমিউনিটিগুলোতে উপদেশমূলক কর্মসূচি, সামাজিক মেলামেশায় উৎসাহ সৃষ্টি এবং ব্রিটিশ ন্যাচারালাইজেশনের ফি কমানোর সুপারিশ।
তবে গত ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত কেইসি রিভিউয়ের সমালোচনা করে হারুন খান বলেছিলেন: “আমাদের সামাজিক সংহতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং এতে কেবল মুসলিমদের নয়, ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন”। কেইসি রিভিউয়ে বলা হয়েছে, ব্রিটেনের কিছু কিছু স্থানে পৃথকীকরণ (সেগ্রিগেশন) ও সমাজ-বিচ্ছিন্নতা উদ্বেগজনক পৌঁছে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। কেইসি রিভিউয়ে মুসলিমদের উল্লেখ আছে ২৪৯ বার আর পোলিশদের (পোল্যান্ডের ইমিগ্রেন্ট) উল্লেখ আছে মাত্র ১৪ বার। কেইসি রিভিউয়ে মুসলিম মহিলাদের তথাকথিত দুরবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়, মুসলিম কমিউনিটির কিছু কিছু মহিলা ইংরেজী ভাষায় তেমন একটা কথা বলেন না এবং তাদেরকে ঘরের ভেতরেই রাখা হয়। বর্ণবাদী হিশাবে পরিচিত হওয়ার ভয়ে সরকারি প্রশাসনের লোকজন এই পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলছেন কিংবা উপেক্ষা করে চলছেন-এমন পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করা হয় কেইসি রিভিউয়ে।
# সাপ্তাহিক পত্রিকার সৌজন্যে।