‘মধ্যম আয়ের দেশ হতে রেমিট্যান্সের বিকল্প প্রয়োজন’
প্রকাশিত হয়েছে : ২:০৫:৫৪,অপরাহ্ন ০৫ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ৯৬০ বার পঠিত
ফরিদ আহমেদ ||
বিদায়ী ২০১৬ সালে বিদেশে থেকে চাকরিজীবীদের দেশে পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমেছে ১৭০ কোটি ১৩ লাখ ডলার। বিদেশিদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ এভাবে কমতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
তাদের মতে, মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে শুধু রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর না করে শক্তিশালী রিজার্ভ গড়তে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিকল্প ভাবতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, দেশের অর্থনীতির সব সূচক যখন স্থিতিশীল ঠিক সেই মুহূর্তে রেমিট্যান্সে বড় একটা ধাক্কা এসেছে। বিদেশিদের পাঠানো অর্থ এভাবে ক্রমাগত কমতির দিকে গেলে শঙ্কার কারণ আছে। কারণ বর্তমানে রেমিট্যান্স রিজার্ভের একটি বড় অংশের যোগানদাতা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে বিদেশিদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়া। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর লোক আসছে। আর দেশ থেকে বিদেশে লোক যাচ্ছে কম। আরেকটি কারণ হচ্ছে, যারা যাচ্ছে তার মধ্যে অদক্ষ শ্রমিকই বেশি। রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো ছাড়া বিকল্প নেই। এছাড়া বর্তমানে বিদেশিদের পাঠানো টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন না হয়ে অন্য চ্যানেলে আসছে বলেও মনে করেনি তিনি।’
সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘রেমিট্যান্স এভাবে কমতে থাকলে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। এখনো গ্রামে-গঞ্জে আয়ের প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। পরিবারের একজন সদস্য বিদেশ থাকে। তার উপার্জন দিয়ে পুরো পরিবার চলে।’
সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে হলে শুধু রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর না করে দেশের এক্সপোর্ট বাড়াতে হবে। এজন্য রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সব জটিলতার নিরসন সরকারকেই করতে হবে।’
বাংলাদেশের বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা জোরদার করা ছাড়া মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে দেশের রিজার্ভ পুরোপুরি রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং কোনো কারণে বিদেশিদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভে বড় ধাক্কা আসবে।’
তিনি বলেন, ‘মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে এক্সপোর্ট বাড়ানো ছাড়া সরকারের বিকল্প কিছু নেই। গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক প্রভৃতি রফতানীমুখী খাত তৈরিই হয়ে আছে। জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যার কারণে এ খাতগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।’
বিশ্ব ব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আসলে দেশে বর্তমানে যে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।’
সরকারকে পরামর্শ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি অর্জন করতে হলে শুধু রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর না করে দেশের বিনিয়োগ ও রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এতদিন সরকার তেলভিত্তিক দেশেগুলোর কারণে রেমিট্যান্স কমছে বললেও গত বছরের জুলাই থেকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকেও রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০১৬ সালের শেষ ৬ মাসে ১৫ সালের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে। সুতরাং রেমিট্যান্স ধসের পেছনে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও অনেক কারণ আছে।’
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশে ২০১৬ সালের জুলাইয়ের পরে বেশ কিছু বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঠেকাতে এন্টি মানিল্ডারিংয়ে যে সকল নির্দেশ দিয়েছে সেগুলো অনেক কঠিন হয়ে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো এ ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। এটা ফরমালি রেমিট্যান্স কমার একটা প্রধান কারণ। হয়তোবা ইনফরমালি রেমিট্যান্স দেশে আসছে।’
যুক্তরাজ্যে গণভোটের পরের দিন থেকে পাউন্ডের দর কমতে শুরু করে। ৬ মাসে পাউন্ড প্রায় ১৭ শতাংশ দর হারিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অভিবাস নীতি কী হবে- এটা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছে না। এসব কারণেও রেমিট্যান্স কমেছে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে বিদেশে চাকরিজীবীরা ৩৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণের অর্থ উপার্জন (রেমিট্যান্স) করে দেশে পাঠিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে তারা রেমিট্যান্স বাবদ এক হাজার ৫৩১ কোটি ২১ লাখ ডলার সমপরিমাণের অর্থ দেশে পাঠিয়েছিল। সুতরাং মাত্র বছরের ব্যবধানে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৭০ কোটি ১৩ লাখ ডলার কমেছে। হঠাৎ বিদেশিদের পাঠানো অর্থের ওপর এ ধাক্কাকে অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।