মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান: বৌদ্ধ বর্ণবাদের নির্দয় শিকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৬:৩৪,অপরাহ্ন ০৩ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ১০৬৬ বার পঠিত
মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের মুসলমানদের বিতাড়িত ও নির্মূল করার লক্ষ্যে তাদের ওপর আবারও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ আর নানা নির্যাতনে মেতে উঠেছে দেশটির উগ্র বৌদ্ধ ও সশস্ত্র বাহিনী।
বৌদ্ধদের দাবি তাদের ধর্ম ছিল সব সময়ই শান্তিকামী এবং অহিংস। মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এ ধর্মের মূল নীতির বিরোধী। অন্যদিকে ইসলামও শান্তি, দয়া ও সহিষ্ণুতার ধর্ম। তাই শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর সম্প্রীতি ছিল প্রবাদতূল্য। এ অঞ্চলে বৌদ্ধ আর মুসলমানদের পরস্পরের প্রথা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের নানা দৃষ্টান্তের কথা লেখা আছে ইতিহাসে।
মিয়ানমারের জনসংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮ থেকে ১২ শতাংশ মুসলমান। বেশিরভাগ মুসলমান রয়েছেন পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে। ইসলাম এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে হিজরি প্রথম শতকেই। মুসলিম ব্যবসায়ীরা চীন সফরে যেতেন পশ্চিম মিয়ানমার ও আরকান অঞ্চল দিয়ে। ফলে গোটা মিয়ানমারের মধ্যে উর্বর ও প্রশস্ত আরাকানেই গড়ে ওঠে প্রথম মুসলিম জনপদ। এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম রাজ্য।
মিয়ানমারের উগ্র ও বর্ণবাদী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালি এবং মুহাজির বলে অপবাদ দিয়ে আসছে। একই অজুহাতে সাম্প্রতিক যুগে তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না।
মিয়ানমারে ১৯৬২ সালের সেনা-অভ্যুত্থান ও সেনা-শাসনের পর থেকে মুসলমানদের ওপর চাপ জোরদার করে উগ্র বৌদ্ধরা।
মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো বলছে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা ও শান্তিকামিতার সুযোগে মুসলমানরা এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব বিস্তার করেছে এবং করেছে লুট-তরাজ। বৌদ্ধ ভিক্ষু সমিতি ও ইয়াঙ্গুনের জাতীয়তাবাদী ভিক্ষু গোষ্ঠীসহ বেশ কয়েকটি উগ্র আর ধর্মান্ধ বৌদ্ধ গোষ্ঠী ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচারণা চালাচ্ছে। এইসব গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে সহিংস গোষ্ঠীর নাম ‘নয়-ছয়-নয়’ (‘৯৬৯’)। এই গোষ্ঠী মুসলমানদেরকে মিয়ানমারের বৌদ্ধদের ক্ষমতা ও নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে প্রচার করছে।
উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী ‘৯৬৯’-এর নেতা ‘অশিন ভিরাতু’ প্রায় ৫০ বছর বয়স্ক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু। তাকে রোহিঙ্গা মুসলিম দলনের প্রধান উস্কানিদাতা বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মের নয় দফা বৈরাগ্যবাদ, ৬ দফা শিক্ষা ও গৌতুম বুদ্ধের ৯ টি শিক্ষার প্রতীকীধারী গ্রুপের নেতা হিসেবে ভিরাতুকে মিয়ানমারের বৌদ্ধরা শ্রদ্ধা করেন।
অনেক উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুকে নিজের কাছে টানতে পেরেছেন ভিরাতু। মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর তথা মান্দালয় শহরের মাসউইন মন্দিরের এই ভিক্ষু মিয়ানমারের সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পর্কে মিয়ানমারের অশিক্ষিত আর অজ্ঞ বৌদ্ধদের মধ্যে বিষাক্ত নানা ধারণা ও ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি শ্রীলংকার বৌদ্ধদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে ভিরাতুর প্রচারিত ইসলাম-বিদ্বেষী নানা ধারণা।
ভিরাতুর উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠীর মত শ্রীলংকার উগ্র বৌদ্ধদের মধ্যেও সক্রিয় রয়েছে ‘বি বি এস’ বা ‘বদু বালা সেনা’ নামের একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর প্রধান মুসলমানদেরকে উগ্রবাদী ও হিংস্র বলে অভিযোগ করছেন। তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের একটি আন্তর্জাতিক জোট গঠনের দাবি জানাচ্ছেন।শ্রীলংকায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তারা সিংহলি ও তামিলদের নানা দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধের বলি হয়েছেন নানা সময়ে। অথচ উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বলছেন শ্রীলংকার মুসলমানরা বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে এই দেশটিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
মিয়ানমারের ‘অশিন ভিরাতু’ও একই ধরনের কথা বলে আসছেন। অনেকেই তাকে ‘মিয়ানমারের বিন লাদেন’ বলে অভিহিত করছেন। ভিরাতুকে তার সমালোচক ও বিরোধীরা নব্য-নাৎসি বলেও অভিহিত করছেন। বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে মিয়ানমারের মুসলমানরা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ে পরিণত হতে চায় বলে তিনি দাবি করে আসছেন। মুসলমানদের সঙ্গে লেন-দেন না করতে ও তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না করতে নিজ অনুসারীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন ভিরাতু। তিনি মুসলমানদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতেও উস্কানি দিয়ে আসছেন।
ভিরাতু দাবি করছেন যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের চাকরি আর আয়-উপার্জনের সুবাদে দিনকে দিন শক্তিশালী হচ্ছে; তাই তারা মিয়ানমারের বৌদ্ধ এবং আশপাশের দেশগুলোর জন্য বিপজ্জনক ও শক্তিশালী শত্রু। তার মতে মুসলমানরা বৌদ্ধদের সব সম্পদের ওপর ক্রমেই থাবা বিস্তার করছে। অথচ মিয়ানমারের বেশিরভাগ ভিক্ষু ও জনগণ ভিরাতুর এইসব দাবি ও চিন্তাধারার বিরোধী। বরং তারা মুসলমানদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী ‘৯৬৯’-এর সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে তারা সোচ্চার হতে পারছেন না।
উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী ‘৯৬৯’ প্রথমে মুসলমানদের বয়কট করার বা তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বলতো। কিন্তু এখন তারা মুসলমানদেরকে মিয়ানমার থেকে তাড়িয়ে দেয়ার কথা বলছে। আর তাই উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী ‘৯৬৯’ মুসলমানদের বিরোধী একটি সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই গোষ্ঠী প্রায়ই মিয়ানমারের মুসলমানদের ব্যাপারে এ গুজব ছড়ায় যে তারা বৌদ্ধ নারীদের ধর্ষণ করেছে। আর এসব অপবাদ দিয়ে উগ্র বৌদ্ধরা বর্ণবাদী নীতি বাস্তবায়ন করছে। ওরা এ জাতীয় অপবাদ দিয়ে এ পর্যন্ত বহু রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে এবং তাদের ঘর-বাড়ি ও কর্মস্থল পুড়িয়ে দিয়েছে।
মিয়ানমারের ‘অশিন ভিরাতু’ এই দেশটিকে কেবল বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশে পরিণত করতে চান এবং বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর নানা ক্ষেত্রে বৌদ্ধদেরকে একক কর্তৃত্বের অধিকারী করতে চান। আর তাই তিনি বৌদ্ধ উপাসনালয় বা মঠগুলোতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ মাত্রায় বিদ্বেষ ছড়ানোর শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি এসব শিক্ষায় বলছেন যে, মিয়ানমারের জনগণ যদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় তাহলে তাদেরকে অবশ্যই মুসলমানদের থেকে পৃথকভাবে জীবন যাপন করতে হবে।
মুসলিম বিদ্বেষী চিন্তাধারা ছড়ানোর দায়ে ২০০৩ সালে ‘অশিন ভিরাতুকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাত বছর পর সাধারণ ক্ষমার সরকারি ঘোষণার আওতায় ভিরাতু কারাগার থেকে মুক্তি পান। বর্ণবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি বলছেন, বৌদ্ধদের মধ্যে স্বাদেশিকতা কম এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দরকারের চেয়েও খুব বেশি সহিষ্ণু।
২০১২ সালে মিয়ানমারের ‘অশিন ভিরাতু’র নেতৃত্বাধীন উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী ‘৯৬৯’ মুসলমানদের ওপর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ বা গণহত্যা শুরু করে। তারা অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ সময় মিয়ানমারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থিইন সিয়েন ও সশস্ত্র বাহিনীও উগ্র বৌদ্ধদের সহায়তা দেয়। ফলে অশিন ভিরাতুর শক্তি ও মুসলিম-বিরোধী সহিংসতা দিনকে দিন বাড়তে থাকে।
মিয়ানমার একটি দরিদ্র দেশ। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থান। মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৪৮ সনে। দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামে স্থানীয় মুসলমানদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্রিটেনে অবস্থিত বৌদ্ধদের উপাসনালয় বিষয়ক ফেডারেশনও মিয়ানমারের মুসলিম বিদ্বেষী উগ্র বৌদ্ধ নেতা অশিন ভিরাতুর সহিংস তৎপরতাগুলোকে সমর্থন দেয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সুপরিকল্পিত গণহত্যায় পাশ্চাত্যের ইন্ধন রয়েছে। মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখার জন্য পাশ্চাত্য দেশটির মুসলমানদের ওপর যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে।